পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খৃষ্ট \O08 VO এই কথাটা বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে বিশেষ দেশকলপাত্রের মধ্যে ক্ষুদ্র করে দেখলে সত্যকে তার আপনি গৃহ থেকে নির্বাসিত করে কারাশূঙ্খলে বেঁধে মারবার চেষ্টা করা হবে । আসল সত্য এই যে, আমার মধ্যে যিনি বড়ো, যিনি আমার হাতে চিরদিন দুঃখ পেয়ে আসছেন, তিনি বলছেন, “জগতের সমস্ত পাপ আমাকেই মারে, কিন্তু আমাকে মারতে পারে না। আজ পর্যন্ত সব চেয়ে বড়ো চোর কি সব ধন হরণ করতে পেরেছে। মানুষের পরম সম্পদের কি ক্ষয় হল । বিশ্বাসঘাতক আছে, কিন্তু সংসারে বিশ্বাস মরে নি । হিংসক আছে, কিন্তু ক্ষমাকে সে মারতে পারলে 动 白 সেই বড়ো যিনি, তিনি তার বেদনায় অমর | কিন্তু সেই ব্যথাই যদি চরম সত্য হত তা হলে কি রক্ষা ছিল। বড়োর মধ্যে আনন্দের অমৃত আছে বলেই তো বেদনা সহ্য হল । ছোটাে কি লেশমাত্র ব্যথা সইতে পারে। সে কি তিলমাত্র কিছু ছাড়তে পারে। কেন পারে না। তার আছে কী যে পারবে । তার প্ৰেম কোথায়, আনন্দ কোথায় । আমরা তো ভারে ভারে কলুষ এনে জমাচ্ছি। যে বড়ো সে ক্রমাগত তাই ক্ষালন করছে- আপন রক্ত দিয়ে, দুঃখ দিয়ে, অশ্রু দিয়ে। প্রতিদিন এই হচ্ছে ঘরে ঘরে । বড়ো বলছেন, “আমায় মারো, মারো, মারো ! তোমার মার আমি ছাড়া আর কেউ সইবে না ।” তখন আমরা কেঁদে বলছি, “তোমাকে আর মারব না- তুমি যে আমার চেয়ে বেশি । তোমার প্রকাশে ধুলো দিয়েছি- অশ্রুজলে সব ধোব। আজ হতে বসলুম তোমার আসনে, তোমার দুঃখ আমি বইব । তুমি নাও, নাও, নাও, আমার সব নাও ; তুমি ভালোবেসেছি, আমিও বাসব ।’ এমনি করে তবে বিরোধ মেটে । তিনি যখন শান্তি নেন তখন সেই শাস্তির দারুণ দুঃখ আর সহ্য হয় না, তবেই তো পাপের মূল মরে ; নরকদণ্ডে তো মরে যিনি বড়ো তিনি যে প্রেমিক । ছোটােকে নিয়ে তার প্রেমের সাধ্যসাধনা । আকাশের আলো দিয়ে, পৃথিবীর লক্ষ্মীশ্ৰী দিয়ে, মানুষের প্রেমের সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে সাধছেন। আপনার সেই বড়োটিকে দেখে মন মুগ্ধ হয়েছে বলেই কবি কবিতা লিখেছে, শিল্পী কারু রচনা করেছে, কমী কর্মে আপনাকে ঢেলে দিয়েছে। মানুষের সকল রচনা এই বলেছে— ‘‘তোমার মতো এমন সুন্দর আর দেখলুম না। ক্ষুধা লোভ কাম ক্ৰোধ এ-যে সব কালো- কিন্তু তুমি কী সুন্দর, কী পবিত্ৰ তুমি, তুমি VITATIS (' মানুষের মধ্যে মানুষের এই যে বড়োর আবির্ভাব, যিনি মানুষের হাতের সমস্ত আঘাত সহ্য করছেন এবং যার সেই বেদনা মানুষের পাপের একেবারে মূলে গিয়ে বাজছে- এই আবির্ভাব তো ইতিহাসের বিশেষ কোনো একটি প্রান্তে নয়। সেই মানুষের দেবতা মানুষের অন্তরেই- তার সঙ্গে বিরোধেই মানুষের পাপ, তারই সঙ্গে যোগেই মানুষের পাপের নিবৃত্তি । মানুষের সেই বড়ো, নিয়ত আপনার প্রাণ উৎসর্গ করে মানুষের ছোটােকে প্ৰাণদান করছেন। রূপকের আকারে এই সত্য খৃষ্টধর্মে প্রকাশ হচ্ছে। পৌষ ১৩২১ শান্তিনিকেতন 趣