পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পল্লীপ্রকৃতি VVG আর-একটা কারণ, ধনী আপনি ধনের দায়িত্ব স্বীকার করত। অর্থাৎ, ধন তখন অসামাজিক ছিল না, তখন প্রত্যেকের ধনে সমস্ত সমাজ ধনী হয়ে উঠত। তখন মান অপমান ও ভোগের তারতম্য ধনকে আশ্রয় করে স্পর্ধিত আত্মম্ভরিতার সঙ্গে মানুষের পরস্পরের সম্বন্ধের পথ রুদ্ধ করে নি। আজ অন্নব্ৰহ্ম লোভের অন্ন হয়ে ছােটাে হয়ে যেতেই একদিন যা সমাজ বেঁধেছে আজ তাই সমাজ ভাঙছে— রক্তে ভাসাচ্ছে পৃথিবী, দাসত্বে জীৰ্ণ করছে মানুষের মন । আজ তাই ধন-অধনের উৎকট অসামঞ্জস্য দূর করবার জন্যে চার দিকেই উত্তেজনা । এখনকার কালের সাধনা, লোকালয়কে আবার সমগ্র করে তোলা । বিশিষ্টে সাধারণে, শক্তিতে সৌহার্দ্য, শহরে গ্রামে মিলিয়ে সম্পূর্ণ করা। বিপ্লবের দ্বারা এই পূর্ণতা ঘটবে না। বিপ্লবকে যারা বাহন করে তারা এক অসামঞ্জস্য থেকে আর-এক অসামঞ্জস্যে লাফ দিয়ে চলে, তারা সত্যকে ছেটে ফেলে সহজ করতে চায় । তারা ভোগকে রাখে তো ত্যাগকে তাড়ায়, ত্যাগকে রাখে তো ভোগকে দেশছাড়া করে- মানবপ্রকৃতিকে পঙ্গু করে তবে তাকে শাসনে আনতে চায়। আমরা এই কথা বলি যে, সত্যকে সমগ্রভাবে না নিতে পারলে মানবস্বভাবকে বঞ্চিত করা হয়- বঞ্চিত করলেই তার থেকে রোগ, তার থেকে অশান্তি। এমন-কি, ঐ যে কলের কথা বলছিলুম- তাকে দিয়ে আমরা বিস্তর অকার্যকরছি বলেই যে তাকে বাদ দেওয়া চলে এ কথা বলা যায় না । এই যন্ত্রও আমাদের প্রাণশক্তির অঙ্গ। এ একেবারেই মানুষের জিনিস। হাতকে দিয়ে ডাকাতি করেছি বলে যে তাকে কেটে ফেললে মঙ্গল হয় তা নয়, সেই হাতকে দিয়েই প্ৰায়শ্চিত্ত করাতে হবে। নিজেকে পঙ্গু করে ভালো হবার সাধনা কাপুরুষতার সাধনা। মানুষের শক্তি নানা দিকে বিকাশ খোজে, তার কোনোটিকে অবজ্ঞা করবার অধিকার আমাদের নেই। আদিমকাল থেকে মানুষ যন্ত্র তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। প্রকৃতির কোনাে-একটা শক্তিরহস্য যেই সৈ আবিষ্কার করে, অমনি যন্ত্র দিয়ে তাকে বন্দী করে তাকে আপনার ব্যবহারের করে নেয়। এর থেকেই তার সভ্যতায় এক-একটা নূতন পর্যায়ের আরম্ভ। প্রথম যেদিন যে লাঙল তৈরি করে মাটির উর্বরতাশক্তিকে কর্ষণ করতে পারলে, সেদিন তার জীবনযাত্রার ইতিহাসে কত বড়ো পর্দা উঠে গেল । সেই উল্মীলিত আবরণ কেবল যে তার অন্নশালাকে বৃহৎ করে অবারিত করলে তা নয়— এতদিন তার মনের যে অনেক কক্ষ অন্ধকার ছিল, তার মধ্যে আলো এনে ফেলল। এই সুযোগে সে নানা দিকেই বড়ো হয়ে উঠল । একদিন পশুচর্ম ছিল মানুষের দেহের আচ্ছাদন— যেদিন চরকায় তীতে সে প্রথম কাপড় বুনলে, সেদিন কেবল যে সে সহজে দেহ ঢাকতে পারলে তা নয়, এতে তার শক্তিকে বড়ো করে উদবােধিত করাতে বহুদূর পর্যন্ত তার প্রভাব বিস্তৃত হল। তাই শুধু মানুষের দেহ নয়, আজকের দিনের মানুষের মন হচ্ছে কাপড়-পরা মন— মানুষে যে মানবলোক সৃষ্টি করছে কাপড়টা তার একটা বড়ো উপাদান। আজকের দিনে আমাদের দেশে আমরা ন্যাশনাল কাপড়টা খাটাে করছি, কিন্তু ও দিকে ন্যাশনাল পতাকাটা বেড়ে চলল। তার মানে কাপড়টা কেবল একটা আচ্ছাদন নয়, ওটা একটা ভাষা । অর্থাৎ কাপড়ে মানুষের মন নিজেকে প্রকাশ করবার একটা নূতন উপাদান পেলে । এ কথা সবাই জানে, পাথরের যুগ থেকে মানুষ যখন লোহার যুগে এল তখন কেবল যে তার বাহ্যশক্তির বৃদ্ধি হল তা নয়, তার আন্তরিক শক্তি প্রসার পেলে । পশুর চারপায়ের অবস্থা থেকে যেদিন মানুষ দুই হাত দুই পায়ের অবস্থায় এল তখনই এর গোড়া-পত্তন। দুই হাত থাকতে পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষমতা মানুষের বেড়ে গেছে- এই তার দেহশক্তির বিশেষত্ব থেকে তার মনের শক্তি বিশেষত্ব পেলে । সেইদিন থেকে হাতের সাহায্যেই মানুষ হাতিয়ার তৈরি করে হাতকেই বহুগুণিত করে চলেছে। তাতে করেই বিশ্বের সঙ্গে তার ব্যবহার কেবলই বেড়ে উঠছে, তার থেকেই তার মনের রুদ্ধদ্বার নানা দিকে খুলে যাচ্ছে। কোনো সন্ন্যাসী যদি বলেন যে, বিশ্বের সঙ্গে ব্যবহারের শক্তিকে সংকুচিত করতে হবে, তা হলে গােড়ায় মানুষের হাত দুটােকেই অপরাধী করতে হয়। ঘোরতর সন্ন্যাসী ততদূর পর্যন্তই যায়। ণে উর্ধর্ববাহু হয়ে থাকে ; বলে, ‘সংসারের সঙ্গে আমার কোনাে ব্যবহারই নেই, আমি মুক্ত। হাতের শক্তিকে খানিক দূর পর্যন্তই এগােতে দেব, তার বেশি এগােতে দেব না- এটা হচ্ছে ন্যূনাধিক