পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१ीथकृठि ७११ সেই পথে চলেছে; তাতে সময় লাগে বেশি, কিন্তু শিকড় নামে গভীরে । প্ল্যান ছিল না বটে, কিন্তু দুটাে-একটা সাধারণ নীতি আমার মনে ছিল, সেটা একটু ব্যাখ্যা করে বলি। আমার ‘সাধনা' যুগের রচনা যাদের কাছে পরিচিত তারা জানেন রাষ্ট্রব্যবহারে পরনির্ভরতাকে আমি কঠোর ভাষায় ভৎসনা করেছি। স্বাধীনতা পাবার চেষ্টা করব স্বাধীনতার উল্টো পথ দিয়ে এমনতরো. বিড়ম্বনা আর হতে পারে না । এই পরাধীনতা বলতে কেবল পরজাতির অধীনতা বোঝায় না। আত্মীয়ের অধীনতাতেও অধীনতার গ্লানি আছে। আমি প্রথম থেকেই এই কথা মনে রেখেছি যে, পল্লীকে বাইরে থেকে পূর্ণ করবার চেষ্টা কৃত্রিম, তাতে বর্তমানকে দয়া করে ভাবীকালকে নিঃস্ব করা হয়। আপনাকে আপন হতে পূর্ণ করবার উৎস মরুভূমিতেও পাওয়া যায়, সেই উৎস। কখনো শুষ্ক হয় না। পল্লীবাসীদের চিত্তে সেই উৎসেরই সন্ধান করতে হবে। তার প্রথম ভূমিকা হচ্ছে তারা যেন আপন শক্তিকে এবং শক্তির সমবায়কে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের উদবোধনে আমরা যে ক্রমশ সফল হচ্ছি। দুটা প্রমাণ আছে আমাদের প্রতিবেশী গ্রামগুলিতে সম্মিলিত আঘােটর আরোগবিধােনর এই গেল এক, আর-একটা কথা আমার মনে ছিল, সেটাও খুলে বলি। সৃষ্টিকাজে আনন্দ মানুষের স্বভাবসিদ্ধ, এইখানেই সে পশুদের থেকে পৃথক এবং বড়ো। পল্লী যে কেবল চাষবাস চালিয়ে আপনি অল্প পরিমাণে খাবে এবং আমাদের ভূরিপরিমাণে খাওয়াবে তা তো নয়। সকল দেশেই পত্নীসাহিত্য পল্লীশিল্প পল্লীগান পল্লীনুত্য নানা আকারে স্বতঃস্ফুর্তিতে দেখা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে আধুনিক কালে বাহিরে পল্লীর জলাশয় যেমন শুকিয়েছে, কলুষিত হয়েছে, অন্তরে তার জীবনের আনন্দ-উৎসেরও সেই দশা। সেইজন্যে যে রূপসৃষ্টি মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম, শুধু তার থেকে পল্লীবাসীরা যে নির্বাসিত হয়েছে তা নয়, এই নিরন্তর নীরসন্তার জন্যে তারা দেহেপ্রাণেও মরে। প্ৰাণে সুখ না থাকলে প্ৰাণ আপনাকে রক্ষার জন্যে পুরো পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করে না, একটু আঘাত পেলেই হাল ছেড়ে দেয়। আমাদের দেশের যে-সকল নকল বীরের জীবনের আনন্দপ্রকাশের প্রতি পালোয়ানের ভঙ্গিতে ভুকুটি করে থাকেন, তাকে বলেন শৌখিনতা, বলেন বিলাস, তারা জানেন না সৌন্দর্যের সঙ্গে পৌরুষের অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ- জীবনে রসের অভাবে বীর্যের অভাব ঘটে । শুকনো কঠিন কাঠে শক্তি নেই, শক্তি আছে পুস্পপাল্লাবে আনন্দময় বনস্পতিতে। যারা বীর জাতি তারা যে কেবল লড়াই করেছে তা নয়, সৌন্দৰ্যরস সম্ভোগ করেছে তারা, শিল্পীরূপে সৃষ্টিকাজে মানুষের জীবনকে তারা ঐশ্বৰ্যবান করেছে, নিজেকে শুকিয়ে মারার অহংকার তাদের নয়ভূগোল্পই যে, অন্য শক্তির সঙ্গে সঙ্গই তাদের আছে সৃষ্টকর্তর আনন্দ্রপদীর সহযােগিতা করবার শক্তি । আমার ইচ্ছা ছিল সৃষ্টির এই আনন্দপ্রবাহে পল্লীর শুষ্কচিত্তভূমিকে অভিষিক্ত করতে সাহায্য করব, নানা দিকে তার আত্মপ্রকাশের নানা পথ খুলে যাবে। এই রূপসৃষ্টি কেবল ধনলাভ করবার অভিপ্ৰায়ে নয়, আন্মলাভ করবার উদেশে । একটা দৃষ্টান্ত দিই। কাছের কোনো গ্রামে আমাদের মেয়েরা সেখানকার মেয়েদের সূচিশিল্পশিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন। তঁদের কোনো একজন ছাত্রী একখানি কাপড়াকে সুন্দর করে শিল্পিত করেছিল। সে গরিব ঘরের মেয়ে। তার শিক্ষয়িত্রীরা মনে করলেন ঐ কাপড়টি যদি তারা ভালো দাম দিয়ে কিনে নেন তা হলে তার উৎসাহ হবে এবং উপকার হবে। কেনবার প্রস্তাব শুনে মেয়েটি বললে, “এ আমি বিক্রি করব না।” এই যে আপন মনের সৃষ্টির আনন্দ, যার দাম সকল দামের বেশি, একে অকেজো বলে উপেক্ষা করব নাকি ? এই আনন্দ যদি গভীরভাবে পল্লীর মধ্যে সঞ্চার করা যায় তা হলেই তার যথাৰ্থ আত্মরক্ষার পথ করা যায়। যে বর্বর কেবলমাত্র জীবিকার গণ্ডিতে বাধা, জীবনের আনন্দ-প্রকাশে যে অপটু, মানবলোকে তার অসম্মান সকলের চেয়ে শোচনীয়। আমাদের কর্মব্যবস্থায় আমরা জীবিকার সমস্যাকে উপেক্ষা করিনি, কিন্তু সৌন্দর্যের পথে আনন্দের