পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ਦਿ ©ፃእ এখনকার মতো খেতাব দেওয়ার প্রথা ছিল না, সংবাদপত্রে তাদের স্তবগান বেরত না । লোকে খাতির করে তাদের বাবু বা মশায় বলত, এর চেয়ে বড়ো খেতাব তখন বাদশা বা নবাবরাও দিতে পারত না । এইরকমের সমন্ত গ্রামের শ্ৰী নির্ভর করত সম্পন্ন গৃহস্থদের উপর। আমি এই ব্যবস্থার প্রশংসা করেছি, কিন্তু এ কথাও সত্য যে এতে আমাদের স্বাবলম্বনের শক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে। আমার জমিদারিতে নদী বহুদূরে ছিল, জলকষ্ট্রের অন্ত ছিল না। আমি প্রজাদের বললুম, “তোরা কুয়ো খুঁড়ে দে, আমি বঁধিয়ে দেব।' তারা বললে, “এ যে মাছের তেলে মাছ ভাজবার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা কুয়ো খুঁড়ে দিলে, আপনি স্বর্গে গিয়ে জলদানের পুণ্যফল আদায় করবেন আমাদের পরিশ্রমে!” আমি বললুম, তবে আমি কিছুই দেব না।” এদের মনের ভাব এই যে ‘স্বর্গে এর জমাখরচের হিসাব রাখা হচ্ছে- ইনি পাবেন অনন্ত পুণ্য, ব্ৰহ্মলোক বা বিষ্ণুলোকে চলে যাবেন, আর আমরা সামান্য জল মাত্ৰ পাব ? আর-একটি দৃষ্টান্ত দিই। আমাদের কাছারি থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত উচু করে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলুম। রাস্তার পাশে যে-সব গ্রাম তার লোকদের বললুম, “রাস্তা রক্ষা করবার দায়িত্ব তোমাদের।” তারা যেখানে রাস্তা পার হয় সেখানে গোরুর গাড়ির চাকায় রাস্তা ভেঙে যায়, বর্ষাকালে দুৰ্গম হয়। আমি বললুম, রাস্তায় যে খাদ হয় তার জন্যে তোমরাই দায়ী, তোমরা সকলে মিলে সহজেই ওখানটা ঠিক করে দিতে পারে।' তারা জবাব দিলে, “বাঃ, আমরা রাস্তা করে দেব। আর কুষ্টিয়া থেকে বাবুদের যাতায়াতের সুবিধা হবে 'অপরের কিছু সুবিধা হয় এ তাদের সহ্য হয় না। তার চেয়ে তারা নিজেরা কষ্টভোগ করে সেও ভালো । এদের ভালো করা বড়ো কঠিন । আমাদের সমাজে যারা দরিদ্র তারা অনেক অপমান সয়েছে, যারা শক্তিমান তারা অনেক অত্যাচার করেছে, তার ছবি আমি নিজেই দেখেছি। অন্য দিকে এই সব শক্তিমানেরাই গ্রামের সকল পূর্তকাজ করে দিয়েছে। অত্যাচার ও আনুকূল্য এই দুইয়ের ভিতর দিয়ে পল্লীবাসীর মন অসহায় ও আত্মসম্মানহীন হয়ে পড়েছে। এরা মনে করে এদের দুর্দশা পূৰ্ব্বজন্মের কর্মফল, আবার জন্মান্তরে ভালো ঘরে জন্ম হলে তাদের ভালো হতে পারে, কিন্তু বর্তমান জীবনের দুঃখদৈন্য থেকে কেউ তাদের বঁাচাতে পারবে না। এই মনোবৃত্তি তাদের একান্ত অসহায় করে তুলেছে। একদিন ধনীরা জলদান, শিক্ষার ব্যবস্থা, পুণ্য কাজ বলে মনে করত । ধনীদের কল্যাণে গ্রাম ভালো ছিল । যেই তারা গ্রাম থেকে শহরে বাস করতে আরম্ভ করেছে অমনি জল গেল শুকিয়ে, কলেরা ম্যালেরিয়া গ্রামকে আক্রমণ করলে, গ্রামে গ্রামে আনন্দের উৎস বন্ধ হয়ে গেল । আজকার গ্রামবাসীদের মতো নিরানন্দ জীবন আর কারও কল্পনাও করা যায় না। যাদের জীবনে কোনো সুখ কোনাে আনন্দ নেই তারা হঠাৎ কোনো বিপদ বা রোগ হলে রক্ষা পায় না। বাইরে থেকে এরা অনেক অত্যাচার অনেকদিন ধরে সহ্য করেছে। জমিদারের নায়েব, পেয়াদা, পুলিস, সবাই এদের উপর উৎপাত করেছে, এদের কান মলে দিয়েছে। এই সব কথা যখন ভেবে দেখলুম। তখন এর কোনো উপায় ভেবে পেলুম না। যারা বহুযুগ থেকে এইরকম দুর্বলতার চর্চা করে এসেছে, যারা আত্মনিৰ্ভরে একেবারেই অভ্যস্ত নয়, তাদের উপকার করা বড়োই কঠিন। তবুও আরম্ভ করেছিলুম কাজ। তখনকার দিনে এই কাজে আমার একমাত্র সহায় ছিলেন কালীমোহন। তার রোজ দু-বেলা জ্বর আসত। ঔষধের বাক্স খুলে আমি নিজেই তার চিকিৎসা করতুম। মনে করতুম তাকে ধাচাতে পারব না। আমি কখনো গ্রামের লোককে অশ্রদ্ধা করি নি। যারা পরীক্ষায় পাস করে নিজেদের শিক্ষিত ও উত্ৰলোক মনে করে তারা এদের প্রতি অশ্রদ্ধাপরায়ণ ।। শ্রদ্ধা করতে তারা জানে না। আমাদের শাস্ত্ৰে বলৈ, শ্ৰদ্ধয়া দেয়ম, দিতে যদি হয় তবে শ্রদ্ধা করে দিতে হবে। এইরকমে আমি কাজ আরম্ভ করেছিলুম। কুঠিবাড়িতে বসে দেখতুম, চাষীরা হাল-বলদ নিয়ে চাষ *াতে আসত ; তাদের ছোটাে ছোটােটুকরো টুকরো জমি। তারা নিজের নিজের জমি চাষ করে চলে শত, আমি দেখে ভাবতেম- অনেকটা শক্তি তাদের অপব্যয় হচ্ছে। আমি তাদের ডেকে বললুম,