পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

હાર রবীন্দ্র-রচনাবলী বাহ্য ফললাভ, এইজন্যে এর মধ্যে বিষয়বুদ্ধিই ছিল মুখ্য ; প্রতিযোগিতার সংকীর্ণ সীমায় ছিল এর মূল্য। বৃহৎ ঐক্যবুদ্ধি এর মধ্যে মুক্তি পেত না । তার পরে এল এক যুগ, তাকে জনক রাজৰ্ষির যুগ নাম দিতে পারি। তখন দেখা গেল দুই বিদ্যার আবির্ভাব। ব্যাবহারিক দিকে কৃষিবিদ্যা, পারমার্থিক দিকে ব্ৰহ্মবিদ্যা। কৃষিবিদ্যায় জনসমাজকে দিলে ব্যক্তিগত স্বার্থের সংকীর্ণ সীমা থেকে বহুল পরিমাণে মুক্তি, সম্ভব করলে সমাজের বহু লোকের মধ্যে জীবিকার মিলন । আর ব্রহ্মবিদ্যা অধ্যাত্মক্ষেত্রে ঘোষণা করলে— আত্মবৎ সর্বভুতেষু য: পশ্যতি স saif কৃষিবিদ্যাকে সেদিন আৰ্যসমাজ কত বড়ো মূল্যবান বলে জেনেছিল তার আভাস পাই রামায়ণে। হলকর্ষণরেখাতেই সীতা পেয়েছিলেন রূপ, অহল্যা ভূমিকে হলযোগ্য করেছিলেন রাম। এই হলকর্ষণই একদিন অরণ্য পর্বত ভেদ করে ভারতের উত্তরকে দক্ষিণকে এক করেছিল । যে অনার্য রাক্ষসেরা আর্যদের শত্রু ছিল, তাদের শক্তিকে পরাভূত করে তাদের হাত থেকে এই নূতন বিদ্যাকে রক্ষা করতে, উদ্ধার করতে বিস্তর প্রয়াস করতে হয়েছিল । পৃথিবীর দান গ্ৰহণ করবার সময় লোভ বেড়ে উঠল মানুষের । অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্র জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হঠিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্ৰ হরণ করে তাকে দিতে লাগল। নগ্ন করে । তাতে তার বাতাসকে করতে লাগল। উত্তপ্ত, মাটি উর্বরতার ভাণ্ডার দিতে লাগল নিঃস্ব করে । অরণ্যের-আশ্রয়-হারা আর্যাবর্ত আজ তাই খরসূৰ্যতাপে দুঃসহ। এই কথা মনে রেখে কিছুদিন পূর্বে আমরা যে অনুষ্ঠান করেছিলুম। সে হচ্ছে বৃক্ষরোপণ, অপব্যয়ী সন্তান -কর্তৃক লুষ্ঠিত মাতৃভাণ্ডার পূরণ করবার কল্যাণ-উৎসব । আজকার অনুষ্ঠান পৃথিবীর সঙ্গে হিসাব-নিকাশের উপলক্ষে নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবার, পৃথিবীর অন্নসত্রে একত্র হবার যে বিদ্যা মানবসভ্যতার মূলমন্ত্র যার মধ্যে, সেই কৃষিবিদ্যার প্রথম উদ্ভাবনের আনন্দ স্মৃতিরূপে গ্ৰহণ করব। এই অনুষ্ঠানকে । কৃযিযুগের পরে সম্প্রতি এসেছে সদৰ্পে যন্ত্রবিদ্যা । তার লৌহবাহু কখনো মানুষকে প্ৰচণ্ডবেগে মারছে অগণিত সংখ্যায়, কখনো তার প্রাঙ্গণে পণ্যদ্রব্য দিচ্ছে ঢেলে প্রভূত পরিমাণে । মানুষের অসংযত লোভ কোথাও আপনি সীমা খুঁজে পাচ্ছে না। একদিন মানুষের জীবিকা যখন ছিল সংকীর্ণ সীমায় পরিমিত, তখন মানুষ ছিল পরস্পরের নিষ্ঠুর প্রতিযোগী। তখন তারা সর্বদাই মারের অন্ত্র নিয়ে ছিল উদ্যত । সে মার আজ আরো দারুণ হয়ে উঠল । আজ তার ধানের উৎপাদন যতই হচ্ছে অপরিমিত তার লোভ ততই তাকে ছাড়িয়ে চলেছে, অন্ত্রশস্ত্ৰে সমাজ হয়ে উঠছে কন্টকিত । আগেকার দিনে পরস্পর ঈর্ষায় মানুষকে মানুষ মারত, কিন্তু তার মারবার অন্ত্র ছিল দুর্বল, তার হত্যার পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। নইলে এত দীর্ঘ যুগের ইতিহাসে এত দিনে একটা পৃথিবীব্যাপী কবরস্থান সমুদ্রের এক তীর থেকে আর-এক তীর অধিকার করে থাকত। আজ যন্ত্রবিদ্যা মানুষের হাতে অস্ত্ৰ দিয়েছে বহু শত শতয়ী, আর যুদ্ধের শেষে হত্যার হিসাব ছাড়িয়ে চলেছে প্রভূত শতসংখ্যা। আত্মশত্ৰু আত্মঘাতী মানুষ ধ্বংসবন্যার স্রোতে গা ভাসান দিয়েছে। মানুষের আরম্ভ আদিম বর্বরতায়, তারও প্রেরণা ছিল লোভ ; মানুষের চরম অধ্যায় সর্বনেশে বর্বরতায়, সেখানেও লোভ মেলেছে আপনােকরাল কবল। জ্বলে উঠেছে প্ৰকাণ্ড একটা চিত- সেখানে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সহমরণে চলেছে তার ন্যায়নীতি, তার বিদ্যাসম্পদ, তার ললিতকলা । r যত্নযুগের বহুপূৰ্ববতী সেই দিনের কথা আজ আমরা স্মরণ করব যখন পৃথিবী স্বহন্তে সন্তানকে পরিমিত অন্ন পরিবেশন করেছেন, যা তার স্বাস্থ্যের পক্ষে, তার তৃপ্তির পক্ষে যথেষ্ট- যা এত বীভৎস রকমে উদ্যবৃত্ত ছিল না, যার ভূপের উপরে কুগ্ৰী লোলুপতায় মানুষ নির্লজ্জভাবে নির্দয় আত্মবিস্মৃত হয়ে লুটােপুটি হানাহানি করতে পারে। SS V Sess If yo8V