পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Qyy রবীন্দ্র-রচনাবলী সহায়তা করুন। নিজেরাই যেমন করে পারি চেষ্টা করেছি। এ সম্বন্ধে বিদেশী লোকের কাছে সাহায্য পেয়েছি, সে কথা কৃতজ্ঞতার সহিত স্বীকার করছি। আমরা আমেরিকার একটি মহিলাকে সহায়-রূপে পেয়েছি। তিনি ডাক্তার নন, যুদ্ধের সময় রোগীর শুশ্ৰষা করাতে কতকটা পরিমাণে হাতে কলমে জ্ঞান হয়েছে, সেইটাকে মাত্র নিয়ে তিনি রোগীদের ঘরে ঘরে এক-ইটুি কাদা ভেঙে গিয়েছেন, অতি দরিদ্রের ঘরে গিয়ে সেবা করেছেন, পথ্য দিয়েছেন- অত্যন্ত ক্ষত ঘী, যা দেখে ভদ্রসমাজের লোকের ঘূণা হয়, সে-সমস্ত নিজের হাতে ধুইয়ে দিয়েছেন- যারা অন্ত্যজ জাতি তাদের ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছেন, পথ খাইয়েছেন - আজ পর্যন্ত তিনি কাজ করছেন, অসহ্য গরমে শরীরের মানি সত্ত্বেও অত্যন্ত দুঃসাধ্য কর্মও তিনি ছাড়েন নি। শরীর যখন ভেঙে পড়ল, শিলং গিয়ে কিছুদিন ছিলেন, ফিরে এসে আবার শরীর নষ্ট করেছেন । এমন করে তঁাকে পেয়েছি। তাকে দেশে যেতে হবে, যে-কয়টা দিন আছেন প্ৰাণপাত করে সেবা করছেন । আর-একজন সহৃদয় ইংরেজ এলমহারস্ট, তিনি এক পয়সা না নিয়ে নিজের খরচে বিদেশ থেকে নিজে টাকা সংগ্রহ করে সে টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তিনি দিনরাত চতুর্দিকের গ্রামগুলির দুরবস্থা কী করে মোচন হতে পারে, এর জন্য কী-না করেছেন বলে শেষ করা যায় না। যে দুজনের সহায়তা পেয়েছি সে দুজন বিদেশ থেকে এসেছেন, এঁদের নিয়ে কাজ করছি । এইটে আপনারা বুঝতে পারেন, পতঙ্গে মানুষে লড়াই । আমাদের রোগশক্রির বাহনটি যে ক্ষেত্ৰ অধিকার করে আছে সে অতি বিস্তীর্ণ। এই বিস্তীর্ণ জায়গায় পতঙ্গের মতো এত ক্ষুদ্র শত্রুর নাগাল পাওয়া যায় না। অন্তত ২৪ জন লোকের দ্বারা তা হওয়া দুঃসাধ্য, সকলে সমবেতভাবে কাজ না করলে কিছুই হতে পারে না। আমরা। হাৎড়াচ্ছিলাম, চেষ্টা-মাত্র করছিলাম, এমন সময়ে আমার জীবাণুতত্ত্ব-বিদ, এমন-কি, ইউরোপে পর্যন্ত তার নাম বিখ্যাত । তিনি খুব বড়ো ডাক্তার, যথেষ্ট অর্থে পাৰ্জন করেন । আপনারা ম্যালেরিয়ার সহিত লড়াই করতে যাচ্ছেন, তিনি সে কাজ আরম্ভ করেছেন ; নিজের ব্যবসায়ে ক্ষতি করে একটা পণ নিয়েছেন- যতদূর পর্যন্ত সম্ভব বাংলাদেশকে তার প্রবলতম শত্রুর হাত থেকে বাচাবার জন্য চেষ্টা করবেন।’ যখন এ কথা শুনলাম, আমার মন আকৃষ্ট হল। আমাদের এই কাজে তার সহায়তা দাবি করতে সংকল্প করলুম। মশা মারবার অস্ত্ৰ পাব। এজন নয় ; মনে হল এমন একজন দেশের লোকের খবর পাওয়া গেল যিনি কোনোরকম রাগ-দ্বেষ উত্তেজনায় নয়, বাহিরের তাড়নায় নয়, কিন্তু একান্তভাবে কেবলমাত্র দেশের লোককে বাচাবার উপলক্ষে, নিজের স্বাৰ্থ ত্যাগ করে, নিজেকে ক্ষতিগ্ৰন্ত করে, এমন করে কাজ করতে প্ৰবৃত্ত হয়েছেন- এইরূপ দৃষ্টান্ত বড়ো বিরল। আমার মনে খুব ভক্তির উদ্রেক হল বলে আমি বললাম, তার সঙ্গে দেখা করে এ বিষয় আলোচনা করতে চাই । এমন সময় তিনি স্বয়ং এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, তার কাছে শুনলাম। তিনি কী ভাবে কাজ আরম্ভ করেছেন । তখন এ কথা আমার মনে উদয় হল, যদি এঁর কাজের সঙ্গে আমাদের কাজ জড়িত করতে পারি তা হলে কৃতাৰ্থ হব, কেবল সফলতার দিক থেকে নয়- এর মতো লোকের সঙ্গে যোগ দেওয়া একটা গৌরবের বিষয় । আপনারা দেখেছেন, যুদ্ধের পর এই-যে জার্মানি-অষ্টিয়ার প্রতিভা স্নান হয়ে যাচ্ছে, অনাহারে দৈহিক দুর্বলতা তার কারণ। যখন ব্লকেড-দ্বারা খাবার বন্ধ করা হয়েছিল সে সময় অনাহারে অনেক মানুষ মরেছে সেইটাই বড়ো কথা নয়। যেসমস্ত শিশুর দুধ খাওয়ার দরকার ছিল, যে-সমস্ত প্রসূতির পুষ্টিকর খাদ্যের দরকার ছিল, তারা তা না পাওয়ায় এই যুগের শিশুরা অপরিপুষ্ট হয়ে পৃথিবীতে এল । এর ফলে এরা বড়ো হলে তেমন বুদ্ধিশক্তির জোর নিয়ে দাড়াতে পারবে না। কাজেই এই হিসাবে দেখতে গেলে মাথা-গণতি অনুসারে লোকসংখ্যা হয় না, যাদের মাথা আছে তাদের কার্যকারিতা কতদূর তা দেখতে হবে। শুধু সংখ্যাগণনা ঠিক গণনা নয়। বাংলাদেশে আমরা ভাবছি না- যেখানে আমাদের স্বাস্থ্যের মূল উৎস সেখানে সব শুকিয়ে যাচ্ছে। আমরা রোগের বোঝা ঘাড়ে কমে নিয়ে রক্তের মধ্যে চিরদুর্বলতা বহন করে আছি। প্রতি বৎসর কত লোক জন্মাচ্ছে, কত লোক মরছে, সংগী