পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্জীপ্ৰকৃতি \Obr কত বুদ্ধি হচ্ছে, এটা বড়ো কথা নয় ; যারা টিকে রইল। তারা মানুষের মতো রইল কি না সেইটে বড়ো কথা । তাদের কার্যকারিতা, মাথা খাটাবার শক্তি, আছে কি না সেইটে বড়ো কথা। নতুবা জীবস্মৃতের দল যদি অধিকাংশ হয় । তার বোঝা জাতি বইতে পারবে না । শারীরিক দুর্বলতা থেকে মানসিক দুর্বলতা আসে। ম্যালেরিয়া রক্তের মধ্যে অস্বাস্থ্য উৎপাদন করে, সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যেও বল পাই না। যার প্রাণের প্রাচুর্য আছে সে প্ৰাণ দিতে পারে । যার কেবল কোনোরকমে বেঁচে থাকা চলে, জীবনধারণের জন্য যা দরকার তার বেশি যার একটু উদবুত্ত হয় না, তার প্রাণে বদ্যান্যতা থাকে না । প্রাণের বদান্যতা না থাকলে বড়ো সভ্যতার সৃষ্টি হতে পারে না। যেখানে প্রাণের কৃপণতা সেখানে ক্ষুদ্রতা আসবে। প্রাণের শক্তির এত বড়ো ক্ষয় কোনাে সভ্য দেশে কখনাে হয় নি। একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুৰ্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী । না, সেই দুৰ্গতির কারণকে অনিবাৰ্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি। চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা । আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াবা কী করে, গভমেন্ট আছে সে কিছু করবে না- আমরা কী করব ! সে কথা বললে চলবে না । যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি- কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে- যে করেই হোক এর যদি প্ৰতিকার না করতে পারি। আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই! ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয় । একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড় হুড় করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে । গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাচাতে পারি। আর-একটা কথা আছে, সেইটো আপনারা ভাববেন । এই-যে নিজের প্রতি অবিশ্বাস এ যদি কোনো-এক জায়গায় মানুষ দূর করতে পারে- সমস্ত অমঙ্গল, এতদিন পর্যন্ত আমরা যা বিধিলিপি বলে মেনে আসছি, যদি এর উল্টা কথা কোনো উপলক্ষে বলতে পারি।-- মস্ত কাজ হয় । শক্ৰ যত বড়োই হােক, তাকে মানব না, মশাকে রাখব না, যেমন করে পারি উচ্ছেদ করব- এ সাহস যদি হয়, তবে কেবল মশা নয়, তার চেয়ে বড়ো শত্রু নিজেদের দীনতার উপর জয়লাভ করব । আর-একটা কথা- পরম্পরের মিলনের নানা উপলক্ষ চাই । এমন অনেক উপলক্ষ চাই যাতে আমাদের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মিলতে পারে। দেশ বলতে যা বুঝি সকলে তা বােঝে না, স্বরাজ কী অনেকে তা বোঝে না । কিন্তু মিলন বলতে যা বুঝি, এমন কেউ নেই যে তা বোঝে না । কিন্তু যদি কোনো-একটা গ্রামের সকলে মিলে কিছু পরিমাণেও রোগ কমাতে পারি, তবে বিদ্বান মুখ সকলের মেলবার এমন সহজ ক্ষেত্র আর হতে পারে না । গোপালবাবু এ কাজ আরম্ভ করেছেন । এই-যে ইনি মণ্ডলদের নাম করলেন, শুনে সুখী হলাম ঐরা একযোগে এক মাটিতে দাড়িয়ে অতি ক্ষুদ্র শত্ৰু মশা মারবার জন্য সকলে মিলে লেগেছেন । এর মতো সুলক্ষণ আর নেই। কারণ, প্রত্যেকের হিতের জন্যে সকলেই দায়ী এবং পরের হিন্তই নিজের সকলের চেয়ে বড়ো হিত, এই শিক্ষার উপলক্ষ আমাদের দেশে যত বেশি হয় ততই ভালো । একটি গ্রামের মধ্যে একটা রাস্তা গিয়েছে, দেখা গেল গোরুর গাড়ি চলায় তার একটা জায়গায় গর্ত হয়েছে- ৪৫ হাতের বেশি নয়- বর্ষার সময় তাতে এক-হাঁটুর উপর কাদা জমে আর সেই কাদার মধ্য দিয়ে স্ত্রী-পুরুষ বালক-বৃদ্ধ হাটবাজার করতে যায়। নিকটবর্তী যামের লোক, যারা সবচেয়ে কষ্ট পায়, তারাও এ কথা বলে না ‘কোদাল দিয়ে খানিকটা মাটি ফেলে জায়গাটা সমান করে দিই, তার কারণ তারাঠকতে ভয় পায়। তারা ভাবে, “আমরাই খািটব অথচ তার সুবিধে আমরা ছাড়াও অন্য সবাই পাবে, এর চেয়ে নিজেরা দুঃখ ভোগ করি সেও ভালো।’ আমি পূর্বেও আপনাদের কাছে বলেছি- একটা গ্রামে বৎসর-বৎসর আগুন লাগত, গ্রামে কুয়া ছিল না, আমি তাদের বললুম, “তোমরা কুয়ো খোড়ো, আমি সে কুয়ো বঁধিয়ে দেব।' তার বললে, “বাবু, মাছের ‘লে মাছ ভাজতে চাও ! অর্থাৎ, অর্ধেক খাটুনি আমাদের, অথচ জলদানের পূণ্যটা সম্পূর্ণ তোমার ! * চেয়ে ইহলোকে আমরা জলাভাবে মারি সেও ভালো, কিন্তু পরলোকে তুমি যে সন্তায় সদগতি *ীত করবে। সে সইতে পারব না। ’ A R A S .