পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V)Sbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বাঙালির কাপড়ের কারখানা ও হাতের তীত বাংলাদেশের কাপড়ের কারখানা সম্বন্ধে যে প্রশ্ন এসেছে তার উত্তরে একটি মাত্র বলবার কথা আছে, এগুলিকে বাচাতে হবে। আকাশ থেকে বৃষ্টি এসে আমাদের ফসলের খেত দিয়েছে ডুবিয়ে, তার জন্যে আমরা ভিক্ষা করতে ফিরছি।--কার কাছে। সেই খেতটুকু ছাড়া যার অন্নের আর-কোনো উপায় নেই, তারই কাছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সাংঘাতিক প্লাবন, অক্ষমতার প্লাবন, ধনহীনতার প্লাবন । এ দেশের ধনীরা ঋণগ্ৰস্ত, মধ্যবিত্তেরা চির দুশ্চিন্তায় মগ্ন, দরিদ্রেরা উপবাসী। তার কারণ, এ দেশের ধনের কেবলই ভাগ হয়, গুণ হয় না । আজকের দিনের পৃথিবীতে যারা অক্ষম তারা যন্ত্রশক্তিতে শক্তিমান । যন্ত্রের দ্বারা তারা আপন অঙ্গের বহুবিস্তার ঘটিয়েছে, তাই তারা জয়ী । এক দেহে তারা বহুদেহ । তাদের জনসংখ্যা মাথা গণে নয়, যন্ত্রের দ্বারা তারা আপনাকে বহুগুণিত করেছে। এই বহুলাঙ্গ মানুষের যুগে আমরা বিরলাঙ্গ হয়ে অন্য দেশের ধানের তলায় শীর্ণ হয়ে পড়ে আছি । সংখ্যাহীন উমেদারের দেশে কেবল যে অন্নের টানাটানি ঘটে তা নয়, হৃদয়ের ঔদার্য থাকে না । প্ৰভুমুখপ্রত্যাশী। জীবিকার সংকীর্ণ ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা বিদ্বেষ কণ্টকিত হয়ে ওঠে। পাশের লোকের উন্নতি সইতে পারি নে। বড়োকে ছোটাে করতে চাই। একখানাকে সাতখানা করতে লাগি । মানুষের যে-সব প্রবৃত্তি ভাঙন ধরাবার সহায় সেইগুলিই প্রবল হয়। গড়ে তোলবার শক্তি কেবলই খোচা খেয়ে খেয়ে মরে । দশে মিলে অন্ন উৎপাদন করবার যে যান্ত্রিক প্ৰণালী তাকে আয়ত্ত করতে না পারলে যন্ত্ররাজদের কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে বাসা ছেড়ে মরতে হবে । মরতেই বসেছি। বাহিরের লোক অন্নের ক্ষেত্রের থেকে ঠেলে ঠেলে বাঙালিকে কেবলিই কোণ-ঠ্যাসা করছে। বহুকাল থেকে আমরা কলম হাতে নিয়ে একা একা কাজ করে মানুষ- যারা সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত, আজ ডাইনে বায়ে কেবলই তাদের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে চলি, নিজের রিক্ত হাতটাকে কেবলই খাটাচ্ছি। পরীক্ষার কাগজ, দরখাস্ত এবং ভিক্ষার পত্র লিখতে । একদিন বাঙালি শুধু কৃষিজীবী এবং মসীজীবী ছিল না। ছিল সে যন্ত্রজীবী । মাড়াইকল চালিয়ে দেশ-দেশান্তরকে সে চিনি জুগিয়েছে। তঁাত-যন্ত্র ছিল তার ধানের প্রধান বাহন । তখন শ্ৰী ছিল তার ঘরে, কল্যাণ ছিল গ্রামে গ্রামে । অবশেষে আরো বড়ো যন্ত্রের দানব-ঠাত এসে বাংলার তাতকে দিলে বেকার করে । সেই অবধি আমরা দেবতার অনিশ্চিত দয়ার দিকে তাকিয়ে কেবলই মাটি চাষ করে মরছি- মৃত্যুর চর নানা বেশে নানা নামে আমাদের ঘর দখল করে বসিল । তখন থেকে বাংলাদেশের বুদ্ধিমানদের হাত বাধা পড়েছে কলম-চালনায়। ঐ একটিমাত্র অভ্যাসেই তারা পাকা, দলে দলে তারা চলেছে আপিসের বড়োবাবু হবার রাস্তায় । সংসারসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে কলম আঁকড়িয়ে থাকে, পরিত্রাণের আর-কোনো অবলম্বন চেনে না । সন্তানের প্রবাহ বেড়ে ভুল-ভূত্রে যার দাক্তি তার উপরে চােখ তুলে ভক্তিরে বলে জীব দিয়েহ্নে দিন আহর দেবেন। ' আহার তিনি দেন না, যদি স্বহন্তে আহারের পথ তৈরি না করি। আজ এই কলের যুগে কলই সেই পথ। অর্থাৎ, প্রকৃতির গুপ্ত ভাণ্ডারে যে শক্তি পূজিত তাকে আত্মসাৎ করতে পারলে তবেই এ যুগে আমরা টিকতে পারব | এ কথা মানি- যন্ত্রের বিপদ আছে। দেবাসুরে সমুদ্রমন্থনের মতো সে বিষও উদগার করে । পশ্চিম-মহাদেশের কল-তলাতেও দুর্ভিক্ষ আজ ওঁড়ি মেরে আসছে। তা ছাড়া, অসৌন্দৰ্য, অশান্তি, অসুখ, কারখানার অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যেরই শামিল হয়ে উঠল। কিন্তু এজন্য প্রকৃতিদত্ত শক্তিসম্পদকে