পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পল্লীপ্রকৃতি । 8OS জলোৎসর্গ ভুবনডাঙায় জলাশয়-প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে কথিত আজকের অনুষ্ঠানসূচীর শেষভাগে আছে আমার অভিভাষণ। কিন্তু যে বেদমন্ত্রগুলি এইমাত্র পড়া হল তার পরে আমি আর কিছু বলা ভালো মনে করি না । সেগুলি এত সহজ, এমন সুন্দর, এমন গভীর যে, তার কাছে আমাদের ভাষা পৌঁছয় না। জলের শুচিতা, তার সৌন্দর্য, তার প্রাণবত্তার অকৃত্ৰিম আনন্দে এই মন্ত্রগুলি নির্মল উৎসের মতো উৎসারিত। আমাদের মাতৃভূমিকে সুজলা সুফলা বলে স্তব করা হয়েছে। কিন্তু এই দেশেই যে জল পবিত্র করে সে স্বয়ং হয়েছে অপবিত্র, পঙ্কবিলীন- যে করে আরোগ্যবিধান সেই আজ রোগের আকর । দুৰ্ভাগ্য আক্রমণ করেছে আমাদের প্রাণের মূলে, আমাদের জলাশয়ে, আমাদের শস্যক্ষেত্রে । সমস্ত দেশ হয়ে উঠেছে তুষার্ত, মলিন, রুগণ, উপবাসী। ঋষি বলেছেন- হে জল, যেহেতু তুমি আনন্দদাতা, তুমি আমাদের অন্নলাভের যোগ্য করো। সর্ববিধ দোষ ও মালিন্য -দূরকারী এই জল মাতার ন্যায় আমাদের পবিত্র করুক ।- জলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশ আনন্দের যোগ্যতা, অন্নলাভের যোগ্যতা, রমণীয় দৃশ্য-লাভের যোগ্যতা প্রতিদিন হারিয়ে ফেলছে। নিজের চারি দিককে অমলিন অন্নবান অনাময় করে রাখতে পারে না যে বর্বরতা, তা রাজারই হােক আর প্রজারই হােক, তার গ্লানিতে সমস্ত দেশ লাঞ্ছিত । অথচ একদিন দেশে জল ছিল প্রচুর, আজ গ্রামে গ্রামে পাকের তলায় কবরস্থ মৃত জলাশয়গুলি তার প্রমাণ দিচ্ছে, আর তাদেরই প্ৰেত মারীর বাহন হয়ে মারছে আমাদের । দেশে রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ও রাষ্ট্রচিন্তা আলোড়িত । কিন্তু আমাদের দেশাত্মবোধ দেশের সঙ্গে আপন প্ৰাণাত্মবোধের পরিচয় আজও ভালো করে দিল না । অন্য সকল লেজার চেয়ে এই লজার কারণকেই এখানে আমরা সব চেয়ে দুঃখকর বলে এসেছি। অনেক দিন পরে দেশের এই প্ৰাণান্তিক বেদনা সম্বন্ধে দেশের চেতনার উদ্রেক হয়েছে। ধরণীর যে অন্তঃপুরগত সম্পদ, যাতে জীবজন্তুর আনন্দ, যাতে তার প্রাণ, তাকে ফিরে পাবার সাধনা আমাদের সকল সাধনার গোড়ায়, এই সহজ কথাটি স্বীকার করবার শুভদিন বোধ হচ্ছে আজ অনেক কাল পরে এসেছে । যে জলকষ্ট সমস্ত দেশকে অভিভূত করেছে তার সবচেয়ে প্রবল দুঃখ মেয়েদের ভোগ করতে হয়। মাতৃভূমির মাতৃত্ব প্রধানত আছে তার জলে- তাই মন্ত্রে আছে : আপো অম্মান মাতরঃ শুদ্ধয়ন্তু । জল মায়ের মতো আমাদের পবিত্র করুক। জলাভাবে দেশে যেন মাতৃত্বের ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতি মেয়েদের দেয় বেদনা। পদ্মাতীরের পল্লীতে থাকবার সময় দেখেছি। চার-পাচ মাইল তফাত থেকে মধ্যাহ্নরৌদ্র মাথায় নিয়ে তপ্ত বালুর উপর দিয়ে মেয়েরা বারে বারে জল বহন করে নিয়ে চলেছে। তুষিত পথিক এসে যখন এই জল চায় তখন সেই দান কী মহাৰ্ঘ দান ! অথচ বারে বারে বন্যা এসে মারছে আমাদের দেশকেই। হয় মারি জলের অভাবে নয় বাহুল্যে । প্রধান কারণ এই যে, পলি ও পাকে নদীগর্ভ ও জলাশয়তাল বহুকাল থেকে অবরুদ্ধ ও অগভীর হয়ে এসেছে। বর্ষণজাত জল যথেষ্ট পরিমাণে ধারণ করবার শক্তি তাদের নেই। এই কারণে যথােচিত আধার-অভাবে সমস্ত দেশ দেবতার অযাচিত দানকে অস্বীকার করতে থাকে, তারই শাপ তাকে ডুবিয়ে ATGK || আমাদের বিশ্বভারতীর সেবাব্রতীগণ নিজেদের ক্ষুদ্র সমর্থ্য-অনুসারে নিকটবতী পল্লীগ্রামের অভাব দূর করবার চেষ্টা করছেন। এদের মধ্যে একজনের নাম করতে পারি, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি এই সম্মুখের বিত্তীর্ণ জলাশয়ের পক্ষোদ্ধার করতে কী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, অনেকেই তা জানেন । বহুকাল পূর্বে রায়পুরের জমিদার ভুবনচন্দ্ৰ সিংহ ভুবনডাঙার এই জলাশয় প্রতিষ্ঠা করে শ্ৰীমবাসীদের জল দান করেছিলেন। তখনকার দিনে এই জলদানের প্রসার যে কিরকম ছিল তা অনুমান করতে পারি যখন জানি এই বাধ ছিল পঁচাশি বিঘে জমি নিয়ে ।