পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ეხrO রবীন্দ্র-রচনাবলী দোকানে-হাটে রাস্তায়-ঘাটে যাহাদের সঙ্গে আমাদের সচরাচর দেখাশুনা হয়, তাহাদের সঙ্গে আমাদের নানান কাজের সম্বন্ধ । তাহদের সঙ্গে আমাদের নানা সাংবাদিক ভাবের আদান প্ৰদান চলে। পরস্পরের দেখাশুনা হইলে, হয় কথাই হয় না, নয় অতি তুচ্ছ বিষয়ে কথা হয়, নয় কাজের কথা চলে। ইহারা তো সাধারণ মনুষ্য। কিন্তু এমন এক এক জনকে আমার চোখের সামনে আমার মনের প্রতিবেশী করিয়া রাখা উচিত, যে আমার আদর্শ মনুষ্য । সে যে সত্যকার আদর্শ মনুষ্য এমন না হইতে পারে ; তাহার মনে যতটুকু আদর্শভাব সেইটুকু সে আমার কাছে প্রকাশ করিয়াছে। তাহার সঙ্গে আমার অন্য কোনো কাজকর্মের সম্পর্ক নাই, কেনা বেচার সম্বন্ধ নাই, দলিল দস্তাবেজের আত্মীয়তা নাই। আমি তাহার নিকট আদর্শ, সে আমার নিকট আদর্শ । আমার মনের বাগান-বাড়ি তাহার জন্য ছাড়িয়া দিয়াছি, সে তাহার বাগানটি আমার জন্য রাখিয়াছে। এ বাগানের কাছে কদৰ্য কিছুই নাই, দুৰ্গন্ধ কিছুই নাই। পরস্পরের উচিত, যাহাতে নিজের নিজের বাগান পুরস্পরের নিকট রমণীয় হয় তাহার জন্য চেষ্টা করা। যত ফুলগাছ রোপণ করা যায়, যত কাটা-গাছ উপড়াইয়া ফেলা হয়, ততই ভালো। এত বাণিজ্য ব্যবসায় বাড়িতেছে, এত কলকারখানা স্থাপিত হইতেছে, যে, গাছপালা-ফুলে-ভরা হাওয়া খাইবার জমি কমিয়া আসিতেছে। এই নিমিত্ত তোমার মনের এক অংশে গাছপালা রোপণ করিয়া রাখিয়া দেওয়া উচিত, যাহাতে তোমার প্ৰিয়তম তোমার মনের মধ্যে আসিয়া মাঝে মাঝে হাওয়া খাইয়া যাইতে পারেন। সে স্থানে অস্বাস্থ্যজনক দূষিত কিছু না থাকে যেন, যদি থাকে তাহা আবৃত করিয়া রাখিও । সত্যকার আদর্শ লোক সংসারে পাওয়া দুঃসাধ্য। ভালোবাসার একটি মহান গুণ এই যে, সে প্ৰত্যেককে নিদেন এক জনের নিকটেও আদর্শ করিয়া তুলে। এইরূপে সংসারে আদর্শ ভাবের চর্চা হইতে থাকে। ভালোবাসার খাতিরে লোককে মনের মধ্যে ফুলের গাছ রোপণ করিতে হয়, ইহাতে তাহার নিজের মনের স্বাস্থ্য-সম্পাদন হয়, আর তাহার মনোবিহারী বন্ধুর স্বাস্থ্যের পক্ষেও ইহা অত্যন্ত উপযোগী। নিজের মনের সর্বাপেক্ষা ভালো জমিটুকু অন্যকে দেওয়ায়, ভালোবাসা ছাড়া আমন আর কে করিতে পারে ? তাই বলিতেছি ভালোবাসা অর্থে আত্মসমৰ্পণ করা নহে, ভালোবাসা অর্থে ভালো বাসা, অর্থাৎ অন্যকে ভালো বাসস্থান দেওয়া, অন্যকে মনের সর্বাপেক্ষা ভালো জায়গায় স্থাপন করা । র্যাহাদের হৃদয়কাননের ফুল শুকাইয়াছে, ফুলগাছ মরিয়া গিয়াছে, চারি দিকে কাটা জন্মিয়াছে, এমন সকল অনুর্বরহাদয় বিজ্ঞ বৃদ্ধেরাই ভালোবাসার নিন্দা করেন। গরীব হইবার সামৰ্থ্য অনেকের গরীব-মানুষি করিবার সামর্থ্য নাই। এত তাঁহাদের টাকা নাই যে, গরীব-মানুষি করিয়া উঠিতে পারে। আমার মনের এক সাধ আছে যে, এত বড়ো মানুষ হইতে পারি যে, অসংকোচে গরীব-মানুষি করিয়া লইতে পারি ! এখনো এত গরীব মানুষ আছি যে গিল্টি-করা বোতাম পরিতে হয়, কবে এত টাকা হইবে যে সত্যকার পিতলের বোতাম পরিতে সাহস হইবে ! এখনো আমার রূপার এত অভাব যে অন্যের সমুখে রূপার থালায় ভাত না খাইলে লজ্জায় মরিয়া যাইতে হয়। এখনো আমার স্ত্রী কোথাও নিমন্ত্রণ খাইতে গেলে তাহার গায়ে আমার জমিদারীর অর্ধেক আয় বাধিয়া দিতে হয় ! আমার বিশ্বাস ছিল রাজশ্ৰীক বাহাদুর খুব বড়ো-মানুষ লোক। সে দিন তাহার বাড়িতে গিয়াছিলাম, দেখিলাম তিনি নিজে গদীর উপরে বসেন ও অভ্যাগতদিগকে নীচে বসান, তখন জানিতে পারিলাম যে তার গরীব-মানুষি করিবার মতো সম্পত্তি নাই। এখন আমাকে যেই বলে যে, ক রায়-বাহাদুর মস্ত বড়োমানুষ লোক, আমি তাহাকেই বলি, “সে কেমন করিয়া হইবে ? তাহা হইলে তিনি গদীর উপর