পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্রসঙ্গ \ტხr(& তুমি । উপভোগ করে না বটে, কিন্তু ইচ্ছা করিলেই করিতে পারে। আমি । সে কথা নিতান্তই ভুল, যদি সে কোনো অবস্থায় ছবি উপভোগ করিতে পারিত তবে তাহা নিজের ঘরেই টাঙাইত। মুর্থ একটি বই কিনিয়া কোনো মতেই তাহা বুঝিতে না পারুক, তথাপি সে বইটিকে আপনার বলিতে সে ছাড়িবে না । তুমি । আচ্ছা, উপভোগ করা চুলায় যাউক । যে বস্তুর উপর সর্বসাধারণের অপেক্ষা তোমার অধিক ক্ষমতা খাটে, যে বইটিকে তুমি ইচ্ছা করিলে অবাধে পোড়াইতে পাের, রাখিতে পাের, দান করিতে পাের, অন্যের হাত হইতে কড়িয়া লইতে পাের, তাহাতেই তোমার অধিকার আছে। আমি। তবুও কথাটা ঠিক হইল না। শারীরিক ক্ষমতাকেই তো ক্ষমতা বলে না। মানসিক ক্ষমতা তদপেক্ষা উচ্চশ্রেণীস্থ । তাহা যদি স্বীকার কর, তাহা হইলে তোমার ভ্ৰম সহজেই দেখিতে পাইবে । তুমি অরসিক, তোমার বাগানের গাছ হইতে একটি গোলাপ ফুল তুলিয়াছ, তোমার হাতে সেটি রহিয়াছে, আমি দূর হইতে দেখিতেছি। তুমি ইচ্ছা করিলে সে গোলাপটি ছিড়িয়া কুটকুটি করিতে পার, সে ক্ষমতা তোমার আছে, কিন্তু সে গোলাপটির সৌন্দৰ্য উপভোগ করিবার ক্ষমতা তোমার নাই- ইচ্ছা করিলে আর সব করিতে পাের, কিন্তু মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাঁহাকে উপভোগ করিতে পার না- আর, আমি তাহাকে ছিড়িতে পারি না বটে, কিন্তু দূর হইতে দেখিয়া তাহার সৌন্দর্য উপভোগ করিতে পারি। তাহার গোলাপ ছিড়িবার ক্ষমতা আছে, আমার গোলাপ উপভোগ করিবার ক্ষমতা আছে, কোন ক্ষমতাটি গুরুতর ? তবে কেন সে তাহাকে “আমার গোলাপ” বলে, আর আমি পারি না ? তবে, গোলাপ সম্বন্ধে যেটি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ক্ষমতা আমার তাহা আছে, তবু সে গোলাপের অধিকারী আমি নহি । এ স্থলে দেখা যাইতেছে, যে বলদ চিনি বহন করিয়া থাকে প্রচলিত ভাষায় তাহাকেই চিনির অধিকারী কহে । আর যে মানুষ ইচ্ছা করিলেই সে চিনি খাইতে পারে সে মানুষের সে চিনিতে অধিকার নাই । তুমি হয়ত বলিবে, যাহার উপর আমাদের শারীরিক ক্ষমতা খাটে, চলিত ভাষায় তাহাকেই “আমার” কহে। তাহাও ঠিক নহে, যাহার সহিত আমার হৃদয়ে হৃদয়ে যোগ আছে তাহাকেও তো আমি “আমার” কহি। তুমি । আচ্ছা, আমি হার মানিলাম। কিন্তু তুমি কি সিদ্ধান্ত করিলে শুনি । আমি । যে কোনো পদার্থ আমরা দেখি, শুনি, ইন্দ্ৰিয় বা হৃদয় দিয়া উপলব্ধি করি, তাহাই আমাদের। তুমি যে ফুলকে "আমার বলে তুমি তাহাকে দেখিতে পার, স্পর্শ করিতে পাের, ভ্ৰাণ করিতে পাও; আমি আর কিছু পাই না, কিন্তু যদি তাঁহাকে দেখিতে পাই, তবে সে মুহূর্তেই তাহার সহিত আমার সম্বন্ধ বাধিয়া গেল, সে সম্বন্ধ হইতে কেহ আমাকে আর বঞ্চিত করিতে পরিবে না! তুমিও তাহার সব পাও নি, আমিও তাহার সব পাই নি, কারণ মানুষের পক্ষে তাহা অসম্ভব; তুমিও তাহার কিছু পাইলে, আমিও তাহার কিছু পাইলাম, অতএব তোমারও সে, আমারও সে। এই জন্যই জনক কহিয়াছিলেন, “কোনো পদার্থেই আমার অধিকার নাই, অথবা সমুদয় পদার্থেরই অধিকারী আমি। ফলত ইহলোকে সকল বস্তুতেই সকলের সমান অধিকার রহিয়াছে।” সন্ধা বা উষাকে কেহ “আমার সন্ধ্যা” “আমার উষা" বলে না কেন? যদি বলো তাহার কারণ তাহারা সকল মানুষের পক্ষেই সমান, তাহা হইলে ভুল বলা হয়; আমি সন্ধ্যাকে তোমাদের সকলের চেয়ে অধিক উপভোগ করি, অতএব সেই উপভোগ-ক্ষমতার বলে তোমাদের কাছ হইতে সন্ধ্যার দখলি-স্বত্ব কড়িয়া লইয়া সন্ধ্যাকে বিশেষ করিয়া “আমার সন্ধ্যা” বলি না কেন? তাহার কারণ আমি সন্ধ্যাকে সর্বপ্রকারে অধিক উপভোগ করিতেছি বটে, কিন্তু তাই বলিয়া তোমাদের কাছ হইতে সে তো একেবারে ঢাকা পড়ে নাই। এইরূপে একটা পদার্থকে কেহ-বা কিছু উপভোগ করে, কেহ বা অধিক উপভোগ করে, কিন্তু সে পদার্থটা তাহাদের উভয়েরই।