পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰসঙ্গ Wobra অনুরাগবীক্ষণ আছে তাহা কি কেহ হিসাবের মধ্যে আনিবেন না ? তুমি বলিবে প্রেম যদি অন্ধ না হইবে তবে কেন সে দোষ দেখিতে পায় না ? দোষ দেখিতে পায় না যে তাঁহা নহে। দোষকে দোষ বলিয়া মনে করে না । তাহার কারণ সে এত অধিক দেখে যে দোষের চারি দিক দেখিতে পায়, দোষের ইতিহাস পড়িতে পারে। একটা দোষবিশেষকে মনুষ্যপ্রকৃতি হইতে পৃথক করিয়া লইয়া দেখিলে তাহাকে যতটা কালো দেখায়, তাহার স্বস্থানে রাখিয়া তাহার আদ্যস্তমধ্য দেখিলে তাহাকে ততটা কালো দেখায় না। আমরা যাহাকে ভালোবাসি না তাহার দোষচুকুই দেখি, আর কিছু দেখি না । দেখি না যে মনুষ্যপ্রকৃতিতে সে দোষ সম্ভব, অবস্থাবিশেষে সে দোষ অবশ্যম্ভাবী ও সে দোষ সত্ত্বেও তাহার অন্যান্য এমন গুণ আছে যাহাতে তাহাকে ভালোবাসা যায় । অতএব দেখা যাইতেছে, বিরাগে আমরা যতটুকু দেখিতে পাই অনুরাগে তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি অধিক দেখি । অনুরাগে আমরা দোষ দেখি, আবার সেই সঙ্গে তাহা মার্জনা করিবার কারণ দেখিতে পাই । বিরাগে কেবল দােষ মাত্রই দেখি । তাহার কারণ বিরাগের দৃষ্টি অসম্পূর্ণ, তাহার একটা মাত্র চক্ষু । আমাদের উচিত, ভালোবাসার পাত্রের দোষ গুণ আমরা যে নজরে দেখি, অন্যদের দোষ গুণও সেই নজরে দেখি । কারণ, ভালোবাসার পাত্রদেরই আমরা যথাৰ্থ বুঝি। যাহাদের ভালোবামা প্রশস্ত, হৃদয় উদার, বসুধৈব কুটুম্বকং, তাহার্য সকলকেই মার্জনা করিতে পারেন । তাহার কারণ, তাহারাই যথার্থ মানুষদের বুঝেন, কাহাকেও ভুল বুঝেন না । তাঁহাদের প্রেমের চক্ষু বিকশিত, এবং প্রেমের চক্ষুতে কখনো নিমেষ পড়ে না । তাহারা মানুষকে মানুষ বলিয়া জানেন । শিশুর পদস্থলন হইলে তাহাকে যেমন কোলে করিয়া উঠাইয়া লন, আত্মসংযমনে অক্ষম একটি দুর্বল হৃদয় ভূপতিত হইলে তাহাকেও তেমনি তঁহাদের বলিষ্ঠ বাহুর সাহায্যে উঠাইতে চেষ্টা করেন । দুর্বলতাকে তাহারা দয়া করেন, ঘূণা করেন না । বসন্ত ও বর্ষা এক বিরহিণী আমাদের জিজ্ঞাসা করিয়া পঠাইয়াছেন- বিরহের পক্ষে বসন্ত গুরুতর কি বর্ষা গুরুতর ? এ বিষয়ে তিনি অবশ্য আমাদের অপেক্ষা ঢ়ের ভালো বুঝেন । তবে উভয় ঋতুর অবস্থা দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলিয়াছেন । মেঘকে দূত করিবেন বলিয়াই যে এমন কাজ করিয়াছেন, তাহা বোধ হয় না । বসন্তকালেও দূতের অভাব নাই। বাতাসকেও দূত করিতে পারিতেন । একটা বিশেষ কারণ থাকাই সম্ভব । বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বর্ষা সংসারী, গৃহী। বসন্ত আমাদের মনকে চারি দিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, বর্ষ তাহাকে এক স্থানে ঘনীভূত করিয়া রাখে । বসন্তে আমাদের মন অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যায়, বাতাসের উপর ভাসিতে থাকে, ফুলের গন্ধে মাতাল হইয়া জ্যোৎস্নার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ে ; আমাদের মন বাতাসের মতো, ফুলের গন্ধের মতো, জ্যোৎস্নার মতো, লঘু হইয়া চারি দিকে ছড়াইয়া পড়ে। বসন্তে বহির্জগৎ গহদ্বার উদঘাটন করিয়া আমাদের মনকে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যায়। বর্ষায় আমাদের মনের চারি দিকে বৃষ্টিজলের যবনিকা টানিয়া দেয়, মাথার উপরে মেঘের চাঁদোয়া খাটাইয়া দেয় । মন চারি দিক হইতে ফিরিয়া আসিয়া এই যবনিকার মধ্যে এই চাদোয়ার তলে একত্র হয় । পাখির গানে আমাদের মন উড়াইয়া লইয়া যায়, কিন্তু বর্ষার বজ্ৰসংগীতে আমাদের মনকে মনের মধ্যে স্তম্ভিত করিয়া রাখে। পাখির গানের মতো এ গান লঘু, তরঙ্গময়, বৈচিত্র্যময় নহে ; ইহাতে স্তব্ধ করিয়া দেয়, উচ্ছসিত করিয়া তুলে না। অতএব দেখা যাইতেছে, বর্ষাকালে আমাদের “আমি” গাঢ়তার হয়, আর বসন্তকালে সে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে ।