পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰসঙ্গ Vetts প্ৰাতঃকাল ও সন্ধ্যাকাল উপরে বসন্ত ও বর্ষার যে প্ৰভেদ ব্যাখ্যা করিলাম, প্ৰভাত ও সন্ধ্যার সম্বন্ধেও তাহা অনেক পরিমাণে খাটে । প্ৰভাতে আমি হারাইয়া যাই, সন্ধ্যাকালে আমি ব্যতীত বাকি আর সমস্তই হারাইয়া যায়। প্ৰভাতে আমি শত সহস্র মনুষ্যের মধ্যে একজন ; তখন জগতের যন্ত্রের কাজ আমি সমস্তই দেখিতে পাই ; বুঝিতে পারি। আমিও সেই যন্ত্র-চালিত একটি জীব মাত্র ; যে মহা নিয়মে সূর্য উঠিয়াছে, ফুল ফুটিয়াছে, জনকোলাহল জাগিয়াছে, আমিও সেই নিয়মে জাগিয়াছি, কার্যক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হইতেছি ; আমিও কোলাহলসমুদ্রের একটি তরঙ্গ, চারি দিকে লক্ষ লক্ষ তরঙ্গ যে নিয়মে উঠিতেছে পড়িতেছে, আমিও সেই নিয়মে উঠিতেছি পড়িতেছি। সন্ধ্যাকালে জগতের কল-কারখানা দেখিতে পাই না, এই জন্য নিজেকে জগতের অধীন বলিয়া মনে হয় না ; মনে হয় আমি স্বতন্ত্র, মনে হয় আমিই জগৎ । প্ৰাতঃকালে জগতের আমি, সন্ধ্যাকালে আমার জগৎ । প্ৰাতঃকালে আমি সৃষ্ট, সন্ধ্যাকালে আমি স্ৰষ্টা। প্রাতঃকালে আমা হইতে গণনা আরম্ভ হইয়া জগতে গিয়া শেষ হয়, আর সন্ধ্যাকালে অতি দূর জগৎ হইতে গণনা আরম্ভ হইয়া আমাতে আসিয়া শেষ হয় । তখন আমিই জগতের পরিণাম, জগতের উপসংহার, জগতের পঞ্চমাঙ্ক । জগতের শোকান্ত বা মিলনান্ত নাটক আমাতে আসিয়াই তাহার সমস্ত উপাখ্যান কেন্দ্রীভূত করিয়াছে। আমার পরেই যেন সে নাটকের যবনিকাপাতন। প্ৰাতঃকালে যে ব্যক্তি নাটকের সাধারণ পাত্ৰগণের মধ্যে একজন ছিল, সন্ধ্যাকালে সেই তাহার নায়ক হইয়া উঠে । প্ৰভাতে জগৎ অন্ধকারকে স্তব্ধতাকে ও সেই সঙ্গে “আমি”কে পরাজিত করিয়া তাহার নিজের রাজ্য পুনরায় অধিকার করিয়া লয় । এইরূপে প্ৰাতঃকালে জগৎ রাজা হয় ও সন্ধ্যাকালে আমি রাজা হই । প্ৰাতঃকালের আলোকে “আমি” মিশাইয়া যাই ও সন্ধ্যাকালের অন্ধকারে জগৎ মিশাইয়া যায় । প্ৰাতঃকাল চারি দিক উদঘাটন করিতে করিতে আমাদের নিকট হইতে অতি দূরে চলিয়া যায় ও সন্ধ্যাকাল চারি দিক রুদ্ধ করিতে করিতে আমাদের অতি কাছে আসিয়া দাড়ায় । এক কথায়, প্ৰভাতে আমি জগৎ-রচনার কর্মকারক ও সন্ধ্যাকালে আমি জগৎ-রচনার কর্তকারক । প্ৰভাতে “আমি”-নামক সর্বনাম শব্দটি প্রথম পুরুষ, সন্ধ্যাবেলায় সে উত্তম পুরুষ । আদর্শ প্ৰেম সংসারের-কাজ-চালানে, মন্ত্রবদ্ধ, ঘরকন্নার ভালোবাসা যেমনই হউক, আমি প্রকৃত আদর্শ ভালোবাসার কথা বলিতেছি। যে-হউক এক জনের সহিত ঘেঁষাঘেষি করিয়া থাকা, এক ব্যক্তির অতিরিক্ত একটি অঙ্গের ন্যায় হইয়া থাকা, তাহার। পাচটা আঙুলির মধ্যে ষষ্ঠ আঙুলির ন্যায় লগ্ন হইয়া থাকাকেই ভালোবাসা বলে না। দুইটা আঠবিশিষ্ট পদার্থকে একত্রে রাখিলে যে জুড়িয়া যায়, সেই জুড়িয়া যাওয়াকেই ভালোবাসা বলে না। অনেক সময়ে আমরা নেশাকে ভালোবাসা বলি। রাম ও শ্যাম উভয়ে উভয়ের কাছে হয়ত “মীেতাতের” স্বরূপ হইয়াছে, রাম ও শ্যাম উভয়কে উভয়ের অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, রামকে নহিলে শ্যামের বা শ্যামকে নহিলে রামের অভ্যাস-ব্যাঘাতের দরুন কষ্ট বোধ হয়। ইহাকেও ভালোবাসা বলে না। প্ৰণয়ের পাত্র নীচই হউক, নিষ্ঠুরই হউক, আর কুচরিত্রই হউক, তাহাকে আঁকড়িয়া ধরিয়া থাকাকে অনেকে প্ৰণয়ের পরাকাষ্ঠী মনে করিয়া থাকে। কিন্তু, ইহা বিবেচনা করা উচিত, নিতান্ত অপদাৰ্থ দুর্বল হৃদয় নহিলে কেহ নীচের কাছে নীচ হইতে পারে না। এমন অনেক ক্ৰীতদাসের কথা শুনা গিয়াছে যাহারা নিষ্ঠুর নীচাশয় প্রভুর প্রতিও অন্ধভাবে আসক্ত, কুকুরেরাও