পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ved O রবীন্দ্র-রচনাবলী সেইরূপ । এরূপ কুকুরের মতো, ক্রীতদাসের মতো ভালোবাসাকে ভালোবাসা বলিতে কোনো মতেই মন উঠে না । প্রকৃত ভালোবাসা দাস নহে, সে ভক্ত ; সে ভিক্ষুক নহে, সে ক্ৰেতা । আদর্শ প্রণয়ীর প্রকৃত সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন, মহত্ত্বকে ভালোবাসেন ; তাহার হৃদয়ের মধ্যে যে আদর্শ ভাব জাগিতেছে তাহারই প্ৰতিমাকে ভালোবাসেন ৷ প্ৰণয়ের পাত্র যেমনই হউক, অন্ধভাবে তাহার চরণ আশ্রয় করিয়া থাকা তাহার কর্ম নহে। তাহাকে তো ভালোবাসা বলে না, তাহাকে কৰ্দমাবৃত্তি বলে। কর্দম একবার পা জড়াইলে আর ছড়িতে চায় না, তা সে যাহারই পা হউক না কেন, দেবতারই হউক আর নরাধমেরই হউক ! প্রকৃত ভালোবাসা যোগ্যপােত্র দেখিলেই আপনাকে তাহার চরণাধুলি করিয়া ফেলে। এই নিমিত্তি ধূলিবৃত্তি করাকেই অনেকে ভালোবাসা বলিয়া ভুল করেন । তাহারা জানেন না। যে, দাসের সহিত ভক্তের বাহা আচরণে অনেক সাদৃশ্য আছে বটে, কিন্তু একটি প্রধান প্ৰভেদ আছে— ভক্তের দাসত্বে স্বাধীনতা আছে, ভক্তের স্বাধীন দাসত্ব । তেমনি প্রকৃত প্ৰণয় স্বাধীন প্ৰণয় । সে দাসত্ব করে, কেননা দাসত্ববিশেষের মহত্ত্ব সে বুঝিয়াছে। যেখানে দাসত্ব করিয়া গীেরব আছে, সেইখানেই সে দাস, যেখানে হীনতা স্বীকার করাই মর্যাদা, সেইখানেই সে হীন । ভালোবাসিবার জন্যই ভালোবাসা নহে, ভালো ভালোবাসিবার জন্যই ভালোবাসা। তা যদি না হয়, যদি ভালোবাসা হীনের কাছে হীন হইতে শিক্ষা দেয়, যদি অসৌন্দর্যের কাছে রুচিকে বদ্ধ করিয়া রাখে, তবে ভালোবাসা নিপাত যাক । বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় অনেক তফাৎ আছে, কিন্তু ঝট করিয়া সে তফাৎ ধরা যায় না। বন্ধুত্ব আটপীেরে, ভালোবাসা পােশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ে দুই-এক জায়গায় ছেড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হাশি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালোবাসার পোশাক একটু ছেড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপটি হইবে । বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাৰ্ছেড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না । আমাদের ভালোবাসার পাত্ৰ হীন প্রমোদে লিপ্ত হইলে আমাদের প্রাণে বাজে, কিন্তু বন্ধুর সম্বন্ধে তাহা খাটে না ; এমন-কি, আমরা যখন বিলাসপ্রমোদে মত্ত হইয়াছি তখন আমরা চাই যে, আমাদের বন্ধুও তাহাতে যোগ দিক ! প্রেমের পাত্র আমাদের সৌন্দর্যের আদর্শ হইয়া থাক এই আমাদের ইচ্ছা— আর, বন্ধু আমাদেরই মতো দোষে গুণে জড়িত মর্ত্যের মানুষ হইয়া থাক এই আমাদের আবশ্যক। আমাদের ডান হাতে বাম হাতে বন্ধুত্ব । আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদন চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই। কিন্তু ভালোবাসার স্থলে আমরা সর্বপ্রথমে ভালোবাসার পাত্রকেই চাই ও তাহাকে সর্বতোভাবে পাইতে চাই বলিয়াই তাহার নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদন চাই, সঙ্গ চাই । কিছুই না পাই যদি, তবুও তাঁহাকে ভালোবাসি। ভালোবাসায় তাহাকেই আমি চাই, বন্ধুত্বে তাহার কিয়দংশ চাই। বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদাৰ্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ । অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ । অতএব বন্ধুত্ব অর্থে দুই এবং তিন, প্রেম অর্থে এক এবং দুই । অনেকে বলিয়া থাকেন বন্ধুত্ব ক্রমশ পরিবর্তিত হইয়া ভালোবাসায় উপনীত হইতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা নামিয়া অবশেষে বন্ধুত্বে আসিয়া ঠেকিতে পারে না। একবার যাহাকে ভালোবাসিয়াছি, হয় তাহাকে ভালোবাসিব নয় ভালোবাসিব না ; কিন্তু একবার যাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব হইয়াছে, ক্রমে তাহার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হইতে আটক নাই। অর্থাৎ বন্ধুত্বের উঠিবার নামিবার স্থান আছে। কারণ, সে সমস্ত স্থান আটক করিয়া থাকে না। কিন্তু ভালোবাসার উন্নতি অবনতির স্থান নাই। যখন