পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্রসঙ্গ Ved A ঝরিয়া পড়বার লক্ষণ প্রকাশিত হয়। আমার বলপূর্বক-ফোটান কবিতার কুঁড়িগুলিও দেখিতে দেখিতে ঝরিয়া পড়ে। কিন্তু ইহা অপেক্ষাও আমার আর একটা আপশোষ আছে ; আমার যে কুঁড়িগুলি ফুটিল না সেগুলি যদি ফুটিত, যে মুকুলগুলি ঝরিয়া গেল তাহাতে যদি ফল ধরিত, তবে কি কীর্তিই লাভ করিতাম !” মাছ ধরা উপরের কথা হইতে একটা দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়িতেছে। ভাবের সরোবরে আমরা জাল ফেলিয়া মাছ ধরিতে পারি না ; ছিপ ফেলিয়া ধরিতে হয় । মাছ ধরিবার জাল আবিষ্কার হয় নাই ; জানি না, কোনাে কালে হইবে কি না। ছিপ ফেলিয়া বসিয়া আছি, কখন মাছ আসিয়া ঠোকরায় ; কিন্তু ঠোকরাইলেই হইল না, মাছকে ডাঙায় তোলাই আসল কাজ। জলের মধ্যে অনেক ভােব কিলবিল করিয়া থাকে, কিন্তু তাঁহাদের ডাঙায় উঠাইয়া তোলা সাধারণ ব্যাপার নহে। ঠোকরাইল, বড়শি লাগিল না ; বড়শি লাগিল, ছিডিয়া পলাইল । অনেক মাছ যতক্ষণ জলে আছে, যতক্ষণ খেলাইতেছি, ততক্ষণ মনে হইতেছে প্ৰকাণ্ড ; তুলিয়া দেখি, যত বড়ো মনে হইয়াছিল তত বড়োটা নয়। ভাব আকর্ষণ করিবার জন্য কত প্রকার চার ফেলিতে হয়, কত কৌশল করিতে হয়, তাহা ভাবব্যবসায়ীরা জানেন । জল নাড়া না পায়, খুব স্থির থাকে ; ভাব যখন বড়শিবিদ্ধ হইল, তবুও জোর করিতেছে, উঠিতেছে না, তখন যেন অধীর হইয়া টানাহেঁচড়া করিয়া উঠাইবার চেষ্টা না করা হয়— তাহা হইলে সূতা ছিড়িয়া যায়— যথেষ্ট খেলাইয়া আয়ত্ত করিয়া তুলিবে । আমরা পরের মনঃসরোবর হইতেও মাছ তুলিয়া থাকি । আমার এক সহচর আছেন, তাহার পুষ্করিণী আছে কিন্তু ছিপ নাই। অবসরমত আমি তাহার মন হইতে মাছ ধরিয়া থাকি, খ্যাতিটা আমার । নানা প্রকার কথোপকথনের চার ফেলিয়া তাহার মাছগুলাকে আকর্ষণ করিয়া আনি ও খেলাইয়া খেলাইয়া জমিতে তুলি । ইচ্ছার দাম্ভিকতা এক জন কবি স্মৃতি সম্বন্ধে বলিতেছেন যে, জীবনের প্রতি বিধাতার এ কি অভিশাপ যে, কাহারও প্রতি অনুরাগ বা কোনাে একটা প্রবৃত্তি ভুলিয়া যাওয়া যখন আমাদের আবশ্যক হয়— মহত্তর উন্নততর প্রশান্ততর কর্তব্য আসিয়া যখন আদেশ করে 'ভুলিয়া যাও'- তখন আমরা ভুলি না ; কিন্তু প্ৰতি মুহূর্ত, প্রতি দিন, সামান্য ঘটনার তুচ্ছ ধূলিকণাসমূহ আনিয়া আমাদের স্মৃতি ঢাকিয়া দেয় ও অবশেষে আমরা ভুলি ; ভুলিতেই হইবে বলিয়া ভুলি, ভুলিতে চাহিয়াছিলাম বলিয়া ভুলি না।- বাস্তবিক, এ কী দুঃখ! আমরা নিজের মনের উপর নিজের ইচ্ছা প্রয়ােগ করিলাম, সে কোনাে কাজে লাগিল না, আর আমাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বহিঃস্থিত সামান্য কতকগুলা জড় ঘটনা সেই কাজ সিদ্ধ করিল ! একটা কেন, এমন সহস্ৰ দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। এক জন সর্বতোভাবে ভালোবাসিবার যোগ্যপাত্ৰ- জানি তাহাকে ভালোবাসিলে সুখী হইব ও আমার সকল বিষয়ে মঙ্গল হইবে— প্রতিনিয়ত ইচ্ছা করিয়াও তাহাকে ভালোবাসিতে পারিলাম না। আর এক জনকে ভালোবাসিলাম কেন ? না, তাহার সঙ্গে কী লগ্নে কী মহান্দ্ৰে ক্ষণে দেখা হইয়াছিল, তাহার কী একটি সামান্য কথার ভাব, কী একটি তুচ্ছ ভাবের আধখানা মাত্র দেখিয়ছিলাম, বলা নাই কহা নাই, ব্যস্তসমস্ত হইয়া একেবারে সমস্ত হৃদয়টা তাহার পায়ের তলায় ফেলিয়া দিলাম। কোনো লেখক যখন কেবলমাত্র ইচ্ছাকে ভােব শিকার করিতে পাঠান,