পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰসঙ্গ Voès & একবার কল্পনা করা যাক, পৃথিবীর বহির্ভাগে দেবতারা সহস্র তারকানেত্ৰ মেলিয়া এই অভিনয় দেখিতেছেন। কি আগ্রহের সহিত র্তাহারা চাহিয়া রহিয়াছেন ! প্রতি শতাব্দীর অঙ্কে অঙ্কে উপাখ্যান একটু একটু করিয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। প্রতি দৃশ্যপরিবর্তনে তঁহাদের কত প্রকার কল্পনার উদয় হইতেছে, কত কি অনুমান করিতেছেন ! যদি পূর্ব হইতেই এই কাব্য, এই নাটক পড়িয়া থাকেন, তাহা হইলেও কী ব্যগ্রতার সহিত প্রত্যেক অভিনয়ের ফল দেখিবার জন্য উৎসুক রহিয়াছেন ! যেখানে একটা ঔৎসুক্যজনক গর্ভাঙ্ক আসন্ন হইয়াছে, সেইখানে তাহারা আগ্ৰহরুদ্ধ নিঃশ্বাসে মনে মনে বলিতে থাকেন, এইবার সেই মহা-ঘটনা ঘটবে। কী মহান অভিনয় ! কী বিচিত্র দৃশ্য ! কী প্ৰকাণ্ড রঙ্গবেদী ! খাটি বিনয় ভাল জহুরী নহিলে খাটি বিনয় চিনিতে পারে না। এক দল অহংকারী আছে তাহারা অহংকার করা আবশ্যক বিবেচনা করে না। তাহাদের বিস্তৃত জমিদারী, বিস্তর লোকের নিকট হইতে যশের খাজনা আদায় হয়, এই নিমিত্ত তাহদের বিনয় করিবার উপযুক্ত সম্বল আছে। তাহারা সখা করিয়া বিনয় করিয়া থাকে। বাহিরে নাকি জমিজমা যথেষ্ট আছে, এই জন্য বাড়ির সমুখে একখানা বিনয়ের বাগান করিয়া রাখে। যে বেচারীর জমিদারী নাই, আধ্য পয়সা খাজনা মিলে না, সে ব্যক্তি পেটের দায়ে নিজের বাড়ির উঠানে, “অহং” এর বাস্তুভিটার উপরে অহংকারের চাষ করিয়া থাকে, তাহার। আর সখ করিবার জায়গা নাই। নিজমুখে অহংকার করিলে যে দারিদ্র্য প্রকাশ পায়, সে দারিদ্র্য ঢাকিতে পারে এত বড়ো অহংকার ইহাদের নাই। যাহা হউক, ইহাদের মধ্যে এক দল সখা করিয়া বিনয়ী, আর এক দল দায়ে পডিয়া অহংকারী, উভয়ের মধ্যে প্ৰভেদ সামান্য। নিজের গুণহীনতার বিষয়ে অনভিজ্ঞ এমন নিওঁণ শতকরা নিরেনবােবই জন, কিন্তু নিজের গুণ একেবারে জানে না। এমন গুণী কোথায় ? তবে, চব্বিশ ঘণ্টা নিজের গুণগুলি চােখের সামনে খাড়া করিয়া রাখে না। এমন বিনয়ী সংসারে মেলে। অতএব কে বিনয়ী ? না, যে আপনাকে ভুলিয়া থাকে, যে আপনাকে জানে না, তাহার কথা হইতেছে না। বড়োমানুষ গৃহকর্তা নিমন্ত্রিতদিগকে বলেন, “মহাশয়, দরিদ্রের কুটিরে পদার্পণ করিয়াছেন ; আপনাদিগকে আজ বড়ো কষ্ট দেওয়া হইল” ইত্যাদি। সকলে বলে, “আহা মাটির মানুষ !” কিন্তু ইহারা কি সামান্য অহংকারী!! অপ্ৰস্তুত হইলে লোকে যে কারণে কঁদে না, হাসে, ইহারাও সেই কারণে বিনয়বাক্য বলিয়া থাকে। ইহারা কোনোমতেই ভুলিতে পারে না যে, ইহাদের বাসস্থান প্রাসাদ, কুটির নহে। এ অহংকার সর্বদাই ইহাদের মনে জাগরকে থাকে। এই নিমিত্ত ইহাদিগকে সারাক্ষণ শশব্যস্ত হইয়া থাকিতে হয়, পাছে বিনয়ের অভাব প্রকাশ পায়। অভ্যাগত আসিলেই তাড়াতাড়ি ডাকিয়া বলিতে হয়,“মহাশয়,এ কুটির, প্রাসাদ নাহে।” তেমন বৃষ যদি কেহ থাকে তবে এই অহংকারী মশাদের বলে, “বাপু হে, তুমি যে এতক্ষণ আমার শিঙে বসিয়াছিলে, তাহা আমি মূলে জানিতেই পারি নাই, ভো ভো করিতে আসিয়াছ বলিয়া এতক্ষণে টের পাইলাম। তোমার এ বাড়িটা প্রাসাদ কি কুটীর, সে বিষয়ে আমি মুহুর্তের জন্য ভাবিও নাই, আমার নজরেই পড়ে নাই, অতএব ও কথা তুলিবার আবশ্যক । কি?” আমাদের দেশে উক্ত প্রকার অহংকারী বিনয়ের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব। সুকণ্ঠ বলেন “আমার গলা নাই’, সুলেখক বলেন “আমি ছাই ভষ্ম লিখি”, সুরূপসী বলেন “এ পােড়ামুখ লোকের কাছে দেখাইতে লজ্জা করে”! এ ভাবটা দূর হইলেই ভালো হয়। ইহাতে না অহংকার ঢাকা পড়ে, না। সরলতা প্রকাশ হয়! আর, এই সামান্য উপায়েই যদি বিনয় করা যাইতে পারে, তবে তো ‘বিনয় খুব শাস্তা! আসল কথা এই যে, “বিনায়বচন” বলিয়া একটা পদার্থ মূলেই নাই। বিনয়ের মুখে কথা নাই, বিনয়ের অর্থ চুপ করিয়া থাকা। বিনয় একটা অভাবাত্মক গুণ। আমার যে অহংকারের বিষয় আছে