পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓOS রবীন্দ্র-রচনাবলী দাঁড়াইতে পারে, সেই ব্যক্তি নির্লজ। সে ব্যক্তি তাহার ক্ষুদ্র পেখমটি প্রাণপণে ছাড়াইতে থাকে, যাহাতে করিয়া জগতের আর সমস্ত দ্রব্য তাহার পেখমের আড়ালে পড়িয়া যায় ও দায়ে পড়িয়া লোকের চক্ষু তাহার উপরে পড়ে। সে চায়- তাহার পেখমের ছায়ায় চন্দ্রগ্রহণ হয়, সূৰ্যগ্ৰহণ হয়, সমস্ত বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে গ্ৰহণ লাগে। যে লোক গায়ে কাপড় দেয় না। তাহাকে সকলে নির্লজ বলিয়া থাকে, কিন্তু যে ব্যক্তি গায়ে অত্যন্ত কাপড় দেয় তাহাকে কেন সকলে নির্লজ্জ বলে না ? যে ব্যক্তি রঙচঙে কাপড় পরিয়া হীরা জহরতের ভার বহন করিয়া বেড়ায়, তাহাকে লোকে অহংকারী বলে। কিন্তু তাহার মতো দীনহীনের আবার অহংকার কিসের ? যত লোকের চক্ষে সে পড়িতেছে তত লোকের কাছেই সে ভিক্ষুক । সে সকলের কাছে মিনতি করিয়া বলিতেছে, “ওগো, এই দিকে ! এই দিকে ! আমার দিকে একবার চাহিয়া দেখা!” তাহার রঙচঙে কাপড় গলবস্ত্রের চাদরের অপেক্ষা অধিক অহংকারের সামগ্ৰী নহে । আমাদের শাস্ত্ৰে যে বলিয়া থাকে “লজ্জাই স্ত্রীলোকের ভূষণ” সে কি ভাসুরের সাক্ষাতে ঘোমটা দেওয়া, না, শ্বশুরের সাক্ষাতে বােবা হওয়া ? “লজ্জাই স্ত্রীলোকের ভূষণ” বলিলে বুঝায়, অধিক ভূষণ না পরাই স্ত্রীলোকের ভূষণ। অর্থাৎ লজ্জাভূষণ গয়ে পরিলে শরীরে অন্য ভূষণের স্থান থাকে না। দুঃখের বিষয় এই যে, সাধারণত স্ত্রীলোকের অন্য সকল ভূষণই আছে, কেবল লজ্জাভূষণটাই কম। রঙচঙে করিয়া নিজেকে বিক্রেয় পুত্তলিকার মতো সাজাইয়া তুলিবার প্রবৃত্তি তাহদের অত্যন্ত অধিক । লজ্জার ভূষণ পরিতে চাও তো রঙ মোছ, শুভ্র বস্ত্র পরিধান কর, ময়ূরের মতো পেখম তুলিয়া বেড়াইও না। উষা কিছু অন্তঃপুরবাসিনী মেয়ে নয়, তাহার প্রকাশে জগৎ প্রকাশ হয়। কিন্তু সে এমনি একটি লজার বস্ত্ৰ পরিয়া, নিরলংকার শুভ্ৰ বসন পরিয়া, জগতের সমক্ষে প্রকাশ পায় ও তাঁহাতে করিয়া তাহার মুখে এমনি একটি পবিত্র বিমল প্রশান্ত শ্ৰীপ্ৰকাশ পাইতে থাকে যে, বিলাস-আবেশ ময় প্রমোদ-উচ্ছাস উষার ভাবের সহিত কোনো মতে মিশ খায় না- মনের মধ্যে একটা সম্রামের ভাব উদয় হয়। স্ত্রীলোকের পক্ষে লজ্জা কেবল মাত্ৰ ভূষণ নহে, ইহা তাহাদের বর্ম। ঘর ও বাসাবাডি দশের চোখের উপরে যে দিনরাত্রির বাস করিতে চাহে, পরের চোখের উপরেই যাহার বাড়ি ঘর, তাহার আর নিজের ঘর বাড়ি নাই। সেই জন্যই সে রঙচঙে দিয়া পরের চোখ কিনিতে চায়, সেখান হইতে ভ্ৰষ্ট হইলেই সে ব্যক্তি একেবারে নিরাশ্রয় হইয়া পড়ে । ইহারা বাসাড়ে লোক, খামখেয়ালী ঘরওয়ালা উচ্ছেদ করিয়া দিলে ইহাদের আর দাড়াইবার জায়গা থাকে না। কিন্তু ভাবুক লোকদিগের নিজের একটা ঘরবাড়ি আছে, পরের চোখ হইতে বিদায় হইয়া তাহার সেই নিজের ঘরের মধ্যে আসিলেই সে যেন বীচে। ভাবুক লোকেরা যথার্থ গৃহস্থ লোক। আর যাহারা নিজের মনের মধ্যে আশ্রয় পায় না, তাহারা কাজেই পরের চক্ষু অবলম্বন করিয়া থাকে ও রঙচঙে মাখিয়া পরের চক্ষুর খোেশামোদ করিতে থাকে। ভাবুকদিগের নিজের মনের মধ্যে কি অটল আশ্রয় আছে! এই জন্যই দেখা যায়, ভাবুক লোকেরা বাহিরের লোকজনের সহিত বড়ো একটা মিশিতে পারেন না, কণ্ঠাগ্র ভদ্রতার আইন কানুনের কহিত কোনো সম্পর্ক রাখেন না। যেখানে চল্লিশ জন অলস ভাবে হাসিতেছে সেখানে তিনি একচল্লিশ হইয়া তাহাদের সহিত একত্রে দন্ত বিকাশ করিতে পারেন না। দশ ব্যক্তির মধ্যে একাদশ হইবার ঐকান্তিক বাসনা তঁহার নাই।