পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

° のVり রবীন্দ্র-রচনাবলী জগতের জমিদারি তুমি জমি কিনিতেই ব্যস্ত, জগতের জমিদারী বাড়াইতে মন দাও না কেন ? তুমি তো মস্ত ধনী, তোমার অপেক্ষা একজন কবি ধনী কেন ? তোমার জগতের অপেক্ষা তাহার জগৎ বৃহৎ । অত বড়ো জমি কাহার আছে ? তিনি যে চন্দ্ৰ সূৰ্য গ্ৰহ নক্ষত্র সমস্ত দখল করিয়া বসিয়া আছেন । তোমার জগতের মানচিত্রে উত্তরে আফিসের দেয়াল, দক্ষিণে আফিসের দেয়াল, পূর্বেও তাঁহাই, পশ্চিমেও তাঁহাই। কবিদিগের কাছে, জ্ঞানীদিগের কাছে বিষয়কর্ম শেখ । তোমার জগৎ-জমিদারীর সীমা বাড়াইতে আরম্ভ কর । আফিসের দেয়াল অতিক্রম করিয়া দিগন্ত পর্যন্ত লইয়া যাও, দিগন্ত অতিক্রম করিয়া সমস্ত পৃথিবী পর্যন্ত বেষ্টন কর, পৃথিবী অতিক্রম করিয়া জ্যোতিষ্কমণ্ডলে যাও এবং সমস্ত জগৎ অতিক্রম করিয়া অসীমের দিকে সীমা অগ্রসর করিতে থাক । আমি তো দেখিতেছি তোমার যতই জমি বাড়িতেছে ততই জগৎ কমিতেছে। এ যে ভয়ানক লোকসানের লাভ ! অল্প দিন হইল আমার এক বন্ধু গল্প করিতেছিলেন, যে, তিনি স্বপ্ন দেখিয়াছেন— জগৎ নিলাম হইতেছে, চন্দ্ৰ সূৰ্য বিকাইয়া যাইতেছে। বোধ করি যেন এমন নিলাম হইয়া থাকে। ভাবুকগণ বুঝি পূৰ্ব্বজন্মে চড়া দামে চন্দ্র সূর্য তারা বসন্ত মেঘ বাতাস কিনিয়াছিলেন, আর আমরা একটা স্কুল-উদর স্থূলদৃষ্টি ও স্থূলবুদ্ধি লইয়া নিজের ভারে এমনি অবনত হইয়া পড়িয়াছি, যে ইহার উপরে এই সাড়ে তিন হস্তের বহির্ভূত আর কিছু চাপাইবার ক্ষমতা নাই। নিজের বােঝা যতই ভারী বােধ হইতেছে ততই আপনাকে ধনী মনে করিতেছি । ইহা দেখিতেছি না। কত লোক জগতের বোঝা অবলীলাক্রমে বহন করিতেছেন । প্রকৃতি পুরুষ জগৎসৃষ্টির যে নিয়ম, আমাদের ভাবসৃষ্টিরও সেই নিয়ম। মনোযোগ করিয়া দেখিলে দেখা যায় আমাদের মাথার মধ্যে প্রকৃতি পুরুষ দুই জনে বাস করেন। এক জন ভাবের বীজ নিক্ষেপ করেন, আর এক জন তাহাঁই বহন করিয়া, পালন করিয়া, পোষণ করিয়া তাহাকে গঠিত করিয়া তুলেন। এক জন সহসা একটা সুর গাহিয়া উঠেন, আর এক জন সেই সুরটিকে গ্ৰহণ করিয়া, সেই সুরকে গ্রাম করিয়া, সেই সুরের ঠাট তাহার রাগিণী বাধিতে থাকেন। একজন সহসা একটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র নিক্ষেপ করেন, আর এক জন সেই স্মৃলিঙ্গটিকে লইয়া ইন্ধনের মধ্যে নিবিষ্ট করিয়া তাহাতে ফু দিয়া তাহাকে আগুন করিয়া তোলেন । এমন অনেক সময় হয়, যখন আমাদের হৃদয়ে একটি ভাবের আদিম অফুট মূর্তি দেখা দেয়, মুহুর্তের মধ্যেই তাহাকে হয়ত বিসর্জন দিয়াছি, তাহাকে হয়ত বিস্মৃত হইয়াছি, আমাদের চেতনার রাজ্য হইতে হয়ত সে একেবারে নির্বাসিত হইয়া গিয়াছে- অবশেষে বহুদিন পরে এক দিন সহসা সেই বিস্তৃতি পরিত্যক্ত অস্ফুট ভাব, পূর্ণ আকার ধারণ করিয়া, সর্বাঙ্গসুন্দর হইয়া আমাদের চিত্তে বিকশিত হইয়া উঠে। সেই উপেক্ষিত ভাবকে এতদিন আমাদের ভােবরাজ্যের প্রকৃতি যত্নের সহিত বহন করিতেছিলেন, পোষণ করিতেছিলেন, বুকে তুলিয়া লইয়া স্তন দান করিতেছিলেন, অথচ আমরা তাহাকে দেখিতেও পাই নাই, জানিতেও পারি নাই । তেমনি আবার এমন অনেক সময় হয় যখন আমাদের মনে হয় একটি ভাববিশেষ এই মাত্ৰ বুঝি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হইল, আমাদের হৃদয়রাজ্যে এই বুঝি তার প্রথম পদার্পণ, কিন্তু আসলে হয়ত আমরা ভুলিয়া গেছি, কিংবা হয়ত জানিতেও পারি নাই, কখন সেই ভাবের প্রথম অদৃশ্য বীজ আমাদের হৃদয়ে রোপিত হয়- কিছু কাল ‘পরিপুষ্ট হইলে তবে আমরা তাহাকে দেখিতে পাইলাম। ভাবিয়া দেখিতে গেলে, আমরা জগৎ হইতে