পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্রসঙ্গ Գoծ সমাপন লিখিলে লেখা শেষ হয় না । পুঁথি যে ক্রমেই বাড়িতে চলিল। আর, সকল কথা লিখিলেই বা পড়িবে কে ? কাজেই এইখানেই লেখা সাঙ্গ করিলাম । r আমার ভয় হইতেছে, পাছে। এ লেখাগুলি লইয়া কেহ তৰ্ক করিতে বসেন। পাছে কেহ প্ৰমাণ জিজ্ঞাসা করিতে আসেন। পাছে কেহ ইহাদের সত্য-অসত্য আবশ্যক-অনাবশ্যক উপকার-অপকার লইয়া আন্দোলন উপস্থিত করেন । কারণ, এ বইখানি সে ভাবে লেখাই হয় নাই । ইহা, একটি মনের কিছুদিনকার ইতিহাস মাত্র। ইহাতে যে সকল মত ব্যক্ত হইয়াছে তাহার সকলগুলি কি আমি মানি, না, বিশ্বাস করি ? সেগুলি আমার চিরগঠনশীল মনে উদিত হইয়াছিল এইমাত্র। তাহারা সকলগুলিই সত্য, অর্থাৎ ইতিহাসের হিসাবে সত্য, যুক্তিতে মেলে কি না মেলে সে কথা আমি জানি না ! যুক্তির সহিত না মিলিলে যে একেবারে কোনো কথাই বলিব না। এমন প্ৰতিজ্ঞা করিয়া বসিলে কি জানি পাছে এমন অনেক কথা না বলা হয় যেগুলি আসলে সত্য ! কি জানি এমন হয়ত সূক্ষ্ম যুক্তি থাকিতে পারে, এমন অলিখিত তর্কশাস্ত্ৰ থাকিতে পাবে, যাহার সহিত আমার কথাগুলি কোনো না কোনো পাঠক মিলাইয়া লইতে পারেন । আর, যদি নাই পারেন তো সেগুলা চুলায় যাক। তাই বলিয়া প্রকাশ করিতে আপত্তি কি ? আর চুলাতেই বা যাইবে কেন ? মিথ্যাকে ব্যবচ্ছদ করিয়া দেখ না, ভ্ৰমের বৈজ্ঞানিক দেহতত্ত্ব শিক্ষা কর না । জীবিত দেহের নিয়ম জানিবার জন্য অনেক সময় মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিতে হয় । তেমনি অনেক সময়ে এমন হয় না কি, পবিত্র জীবন্ত সত্যের গায়ে অস্ত্ৰ চালাইতে কোনোমতে মন উঠে না, হৃদয়ের প্ৰিয় সত্যগুলিকে অসংকোচে কাটাকাটি ছেড়াছোড়ি করিতে প্ৰাণে আঘাত লাগে ও সেই জন্য মৃত ভ্ৰম মৃত মিথ্যাগুলিকে কাটিয়া কুটিয়া সত্যের জীবন-তত্ত্ব আবিষ্কার করিতে হয় ! আর, পূর্বেই বলিয়াছি এ গ্রন্থ মনের ইতিহাসের এক অংশ। জীবনের প্রতি মুহুর্তে মনের গঠনকার্য চলিতেছে । এই মহা শিল্পশালা এক নিমেষ কালও বন্ধ থাকে না । এই কোলাহলময় পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানবের অদৃশ্য অভ্যন্তরে অনবরত কি নির্মাণকাৰ্যই চলিতেছে! অবিশ্রাম কত কি আসিতেছে। যাইতেছে, ভাঙিতেছে। গড়িতেছে, বর্ধিত হইতেছে, পরিবর্তিত হইতেছে, তাহার ঠিকানা নাই। এই গ্রন্থে সেই অবিশ্রান্ত কাৰ্যশীল পরিবর্তমান মনের কতকটা ছায়া পড়িয়াছে। কাজেই ইহাতে বিস্তর অসম্পূর্ণ মত, বিরোধী কথা, ক্ষণস্থায়ী ভাবের নিবেশ থাকিতেও পারে। জীবনের লক্ষণই এইরূপ । একেবারে স্থৈৰ্য, সমতা ও ছাঁচে-ঢালা ভাব মৃতের লক্ষণ। এই জন্যই মৃত বস্তুকে আয়ত্তের মধ্যে আনা সহজ । চলন্ত স্বাধীন ক্রীড়াশীল জীবনকে আয়ত্ত করা সহজ নহে, সে কিছু দুরন্ত । জীবন্ত উদ্ভিদে আজ যেখানে অঙ্কুর, কাল সেখানে চারা ; আজ দেখিলাম সবুজ কিশলয়, কাল দেখিলাম সে পীতবর্ণ পাতা হইয়া ঝরিয়া পড়িয়ছে ; আজ দেখিলাম কুঁড়ি, কাল দেখিলাম ফুল, পরশু দেখিলাম ফল। আমার লেখাগুলিকেও সেই ভাবে দেখ । এই গ্রন্থে যে মতগুলি সবুজ দেখিতেছি, আজ হয়ত সেগুলি শুকাইয়া ঝরিয়া গিয়াছে। ইহাতে যে ভাবের ফুলটি দেখিতেছি, আজ হয়ত সে ফল হইয়া গিয়াছে, দেখিলে চিনিতে পরিবে না। আমাদের হৃদয়বৃক্ষে প্রত্যহ কত শত পাতা জন্মিতেছে ঝরিতেছে, ফুল ফুটিতেছে শুকাইতেছে— কিন্তু তাই বলিয়া তাহাদের শোভা দেখিবে না ? আজ যাহা আছে আজই তাহা দেখ, কাল থাকিবে না বলিয়া চোখ বুজিব কেন ? আমার হৃদয়ে প্রত্যহ যাহা দিলাম । ইহারা আমার মনের পোষণকার্যের সহায়তা করিয়াছে, তোমাদেরও হয়ত কাজে লাগিতে পারে । - আমি যখন লিখি তখন আমি মনে করি। যাহারা আমাকে ভালোবাসেন তাহারাই আমার বই পড়িতেছেন। আমি যেন এককালে শত শত পাঠকের ঘরের মধ্যে বসিয়া তাহাদের সহিত কথা কহিতেছি। আমি এই বঙ্গদেশের কত স্থানের কত শত পবিত্র গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিতে পাইয়াছি। Σ 8 | 8 \ο