পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

So 海 রবীন্দ্র-রচনাবলী দিনের আলো যখন নিবে এসেচে, পাখিগুলি তাদের নীড়ে তাদের একমাত্র সঙ্গিনীদের কাছে ফিরে এসেছে, দূরে কুঁড়েঘরগুলিতে সন্ধের প্রদীপ জ্বলেচে- তখন কি ঐ চপলার এক মুহূর্তের তরেও আর একটি হৃদয়ের জন্যে প্ৰাণ কঁদে না ? এক মুহুর্তের জন্যও কি ইচ্ছে যায় না- এই কোলাহলশূন্য জগতের মধ্যে আর একটি প্ৰেমপূৰ্ণ হৃদয় নিয়ে দুজনে স্তব্ধ হয়ে দুজনের পানে চেয়ে থাকি। গভীর শান্তিপূর্ণ সেই সন্ধ্যা-আকাশে দুটিমাত্র স্তব্ধ হৃদয় স্তব্ধ আনন্দে বিরাজ করি। দুটি সন্ধাতারার মতো আলোয় আলোয় কথা হয়! হায় এ কি কল্পনা ! এ কি দুরাশা ! নবীনের প্রবেশ নবীন। এ কি ভাই, তুমি যে একলা এখানে বসে আছ ? আমাদের সঙ্গে যে যোগ দাও নি ? নীরদ। এমন মধুর সন্ধে বেলায় কেমন ক’রে যে তুমি ঐ মূর্তিমতী চপলতার সঙ্গে আমোদ ক’রে বেড়াচ্ছিলে আমি তাই বসে ভাবছিলুম। সন্ধের কি একটা পবিত্রতা নেই ? ঐ সময়ে হৃদয়হীন চটুলতা দেখলে কি তার সঙ্গে যোগ দিতে ইচ্ছে করে ? নবীন। তোমরা কবি মানুষ, তোমাদের কথা আমরা ঠিক বুঝতে পারি নে। আমার তো খুব ভালো লাগছিল। আর তোমাদের কবিত্বের চোখেই বা ভালো লাগবে না কেন তাও আমি ঠিক বুঝতে পারি নে! সরলা বালিকা, মনে কোনাে চিন্তা নেই, প্রণের স্মৃর্তিতে সন্ধ্যার কোলে খেলিয়ে বেড়াচ্চে এই বা দেখতে খারাপ লাগবে কেন ? নীরদ । তা ঠিক বলেচ ! (কিছুক্ষণ ভাবিয়া) কিন্তু যার কোনাে চিন্তা নেই, সে মন কি মন ? যে হৃদয় আর কোনো হৃদয়ের জন্যে ভাবে না, আপনাকে নিয়েই আপনি সস্তুষ্ট আছে, তাকে কি স্বার্থপর दळद • ! নবীন । তুমি নিজে স্বার্থপর ব’লেই তাকে স্বার্থপর বলচ ! যে হৃদয় তোমার হৃদয়ের জন্যে ভাবে না তার আনন্দ তার হাসি তোমার ভালো লাগে না, এর চেয়ে স্বার্থপরতা আর কি আছে ! আমি তো, ভাই, সে ধাতের লোক নই। সে আমাকে হৃদয় দিক আর নাই দিক আমার তাতে কি আসে যায় ? আমি তার যতটুকু মধুর তা উপভোগ করব না কেন ? তার মিষ্টি হাসি মিষ্টি কথা পেতে আপত্তি কি আছে ! নীরদ। স্বার্থপরতা ? ঠিক কথাই বটে। এত দিনে আমার মনের ভাব ঠিক বুঝতে পারলুম। ঐ সরলা বালা আমোদ ক’রে বেড়াচে তাতে আমার মনে মনে তিরস্কার করবার কি অধিকার আছে। আমি কোথাকার কে ! আমি অনবরত তাকে অপরাধী করি কেন ! নলিনীর প্রবেশ নলিনী । আমাকে মার্জনা কর । নবীন। (তাড়াতাড়ি) আবার ও সব কথা কেন? বড়ো বড়ো হৃদয়ের কথা বলে বালিকার সরল মনকে ভারগ্রস্ত করবার দরকার কি ? (হাসিয়া নলিনীর প্রতি) নলিনী, আজ বিদায় হবার আগে একটি फूल फाँ३ ! নলিনী । বাগানে তো অনেক ফুল ফুটেচে, যত খুশি তুলে নাও না ? নবীন। ফুলগুলিকে আগে তোমার হাসি দিয়ে হাসিয়ে দাও, তোমার স্পর্শ দিয়ে বঁচিয়ে দাও ! ফুলের মধ্যে আগে তোমার রূপের ছায়া পড়ুক, তোমার স্মৃতি জড়িয়ে যােক- তার পরে তাকে ঘরে নিয়ে যাব । নলিনী । (হাসিয়া) বড় তোমার মুখ ফুটেচে দেখােচ ! দিনে দুপুরে কবিতা বলতে আরম্ভ করেচ ! নবীন। আমি কি সাধে বলচি ! তুমি যে জোর করে আমাকে কবিতা বলাচ্চ। তোমার ঐ দৃষ্টির পরেশ-পাথরে আমার ভাবগুলি একেবারে সােনাবীধানাে হয়ে বেরিয়ে আসচে।