পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বললে যে, ভোলানাথের একশিঙওয়ালা ভৃঙ্গীবাবা ষাড়ের মতো গর্জাতে গর্জাতে তাকে এসে তাড়া করেছিল। সে তো কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে সন্ন্যাসী হয়ে। গাছতলায় বসে বসে গাঁজা খাচ্ছে। এখন লোক পাওয়া শক্ত হয়েছে। আর ওর সঙ্গে আমরা পেরে উঠি নে, কেননা মেয়েরা ওর সহায়। ও তাদের সব বশ করে নিয়েছে।” সদু হেসে বললে, “ওর গল্প যতই শুনি আমারই তাে মন টলমল করে ওঠে।” “দেখো, সর্বনাশ কোরো না যেন ।” “না, তোমার ভয় নেই, আমার এত সৌভাগ্য নয়। মেয়েদের চাতুর দিয়ে ঘরকন্না চালাতে হয়, সেটা দেশের সেবায় লাগালে ঐ স্ত্রীবুদ্ধি যোলো-আনা কাজে লাগতে পারে । পুরুষরা বোকা, তারা আমাদের বলে সরলা, অখলা— এই নামের আড়ালেই আমরা সাধবীপন করে থাকি আর ঐ খোকার বাবারা মুগ্ধ হয়ে যায়। আমরা অবলা অখলা, কুকুরের গলার শিকলের মতো এই খ্যাতি আমরা গলায় পরে থাকি, আর তোমরা আমাদের পিছন পিছন টেনে নিয়ে বেড়াও । তার চেয়ে সত্যি কথা বল-না কেন- সুযোগ পেলে তোমরাও ঠকাতে জান, সুযোগ পেলে আমরাও ঠকাতে জানি। আমরা এত বােকা নাই যে শুধু ঠকবই আর ঠকাব না। বুড়িগুলো বলে থাকে ‘সন্দু বড়ো লক্ষ্মী, অর্থাৎ রাধতে বাড়তে ঘর নিকোতে সদুর ক্লান্তি নেই। এইটুকু বেড়ার মধ্যে আমাদের সুনাম । দেশের লোক না। খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে আর যারা মানুষের মতো মানুষ তাদের হাতে হাতকড়ি পড়েছে, আমরা বেঁধে বেড়ে বাসন মেজে করছি সতীসাধবীগিরি ! আমরা অলক্ষ্মী হয়ে যদি কাজের মতন একটা-কিছু করতে পারি তা হলে আমাদের রক্ষা, এই আমি তোমাকে বলে রাখলুম। আমাদের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দেখো তো দেখবে— হয়তো আছে কোথাও কিছু কলঙ্কের চিহ্ন, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই আছে জ্বলন্ত আগুনের দাগা । নিছক আরামের খেলার দাগ নয় । মেরেছি, কিন্তু মরেছি। তার অনেক আগে । সংসারে মেয়ের দুঃখের কারবার করতেই এসেছে। সেই দুঃখ কেবল আমি ঘরকন্নার কাজে ফুকে দিতে পারব না। আমি চাই সেই দুঃখের আগুনে জ্বালিয়ে দেব দেশের যত জমানো আঁস্তাকুড় । লোকে বলবে না। সতী, বলবে না। সাধবী । বলবে দজাল মেয়ে । এই কলঙ্কের-তিলক-আঁকা ছাপ পড়বে তোমার সদুর কপালে, আর তুমি যদি মানুষের মতো মানুষ হও তবে তার গুমোর বুঝতে পারবে ।” “তোমার মুখে ওরকম কথা আমি ঢের শুনেছি, তার পরে দেখেছি সংসার যেমন চলে তেমনি চলছে। মাঝে মাঝে মন খোলসা করা দরকার, তাই শুনি আর হাভানা চুরুট টানি ।” “যাই হােক-না-কেন, আমি জানি আমি যাই করি শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে ক্ষমা করবেই আর সেই ক্ষমাই যথার্থ পুরুষমানুষের লক্ষণ, যেন শ্ৰীকৃষ্ণের বুকে ভৃগুর পায়ের চিহ্ন ! তোমার সেই ক্ষমার কাছেই তো আমি হার মেনে আছি। মিথ্যা স্তব করব না— পুলিসের কাজে তোমার খবরদারির শেষ নেই, কিন্তু আমাকে তুমি চোখ বুজে বিশ্বাস করে এসেছ, যদিও সব সময়ে সেই বিশ্বাসের যোগ্যতা আমার ছিল না। আমি এইজন্যই তোমাকে ভক্তি করি, আমার ভক্তি শাস্ত্ৰমতে গড়া নয়।” “সন্দু আর কেন, পেট ভরে যা বলবার সে তো বলে গেলে, এখন তোমার ঐ কুকুরটাকে খাওয়াতে মৃত্যুচ্ছে—এ আমাকে ঘুমাতে দেবেন। আমি ভাবছি আমাকে এবারে দুটির দরখাস্ত হবে ।” সন্দু হেসে বললে, “তুমি ইনসাপেক্টরি ছেড়ে দিয়ে গাছতলায় বাবাজি সেজে বোসো, তোমার আয় যাবে বেড়ে, আমিও তার কিছু বাখরা পাব।” “সব তাতেই তুমি যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে থাক, আমার ভালো লাগে না।” “ও আমার স্বভাব, তোমার খুনী ডাকাতদের জন্য আমি চিন্তা করতে পারব না। একা তোমার চিন্তাতেই আমার দিন চলে গেল। সমস্ত দেশের লোকের হাসিতে যোগ না দিয়ে আমি করব কী । তোমার এই পুলিসের থানায় স্বদেশীদের নিয়ে অনেক চােখের জল বয়ে গেছে, এত দিনে লোকেরা একটু হেসে বঁাচছে। এইজন্যই অনিলবাবুকে সবাই দুহাত তুলে আশীর্বাদ আমি দুশ্চিন্তার ভান করব কী করে বলে দেখি।” তুলে করছে, তুমি ছাড়া ।