পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓ Sዓ নীরদ । কিন্তু নীরজ, এদেশে কেবল শোভাই আছে, এদেশে হৃদয় নেই। নীরজা । তা হতেই পারে না। এত সৌন্দর্যের মধ্যে হৃদয় নেই। এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না। নীরদ । সৌন্দর্যকে দেখবামাত্রই লোকে তাকে বিশ্বাস ক’রে ফেলে এই জন্যেই তো পৃথিবীতে এত দুঃখ-যন্ত্রণা ! সে কথা যাক- নলিনীদের বাড়িতে আজ বসন্ত-উৎসব- আমাদের নিমন্ত্রণ হয়েছে, একটু শীগগির শীগগির যেতে হবে। নীরজা । আমার একটি কথা রাখবে ? আমি বলি ভাই, সেখানে আমাদের না যাওয়াই ভালো । নীরদ । কেন ? নীরজা । কেন, তা জানি নে, কিন্তু কে জানে, আমার মনে হচ্ছে সেখানে আজ না গেলেই ভালো ! নীরদ । নীরজ, তুমি কি আমার ভালোবাসার প্রতি সন্দেহ করা ? নীরজা । প্রিয়তম, এ প্রশ্ন যদি তোমার মনে এসে থাকে- তবে থাক- তবে আর আমি অধিক কিছু বলব না- তুমি চল ! নীরদ । আমি তো যাওয়াই ভালো বিবেচনা করি । আজ আমার কি গর্বের দিন ! তোমাকে সঙ্গে ক’রে যখন নিয়ে যাব, নলিনী দেখবে আমাকে ভালোবাসবারও একজন লোক আছে। [উভয়ের প্রস্থান পঞ্চম দৃশ্য নলিনীর উদ্যানে বসন্ত-উৎসব নীরদ নীরজা নীরদ। আমরা বড়ো সকাল সকাল এসেছি। এখনো একজনও লোক আসে নি। (স্বগত) সেই তো সব তেমনিই রয়েছে! সেই সব মনে পড়ছে! এই বকুলের তলায় ফুলগুলির উপর সে খেলা করে বেড়াত ! সূর্যের আলো তার সঙ্গে সঙ্গে যেন নৃত্য করত ! তার হাসিতে গানেতে, তার সেই সরল প্ৰাণের আনন্দ-হিল্লোলে গাছের কুড়িগুলি যেন ফুটে উঠত | আমি কি ঘোর স্বার্থপর ! সে হাসি, সে গান আমার কেন ভালো লগত না ! সেই জীবন্ত সৌন্দর্যরাশি আমি কেন উপভোগ করতে পারতুম না। এক দিন মনে আছে সকাল বেলায় ঐ কামিনী গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সুকুমার হাতটি বাড়িয়ে সে অন্যমনস্কে কামিনী ফুল তুলছিল, আমি পিছনে গিয়ে দাড়াতেই হঠাৎ চমকে উঠে তাঁর আঁচল থেকে ফুলগুলি পড়ে গেল, তার সেই চকিত নেত্র তার সেই লজ্জাবনত মুখখানি আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ! আহা, তাকে আর একবার তেমনি ক’রে দেখতে ইচ্ছে করছে ! এই পরিচিত গাছপালাগুলির মধ্যে সূর্যালোকে সে তেমনি ক'রে বেড়াক, আমি এইখানে চুপ ক'রে বসে বসে তাই দেখি ! আমি তাকে আর ভালোবাসি নে বটে, কিন্তু তাই বলে তার যতটুকু সুন্দর তা আমার ভালো না লাগবে কেন ? আহা, সে পুরনো দিনগুলি কোথায় গেল ? নীরজা ! এ বাগানটি কি সুন্দর । , নীরদ । তুমি কেবল এর সৌন্দর্য দেখছ- আমি আরো অনেক দেখতে পাচ্ছি। এই বাগানের প্রত্যেক গাছের ছায়ায় প্রত্যেক লতাকুঞ্জে আমার জীবনের এক একটি দিন, এক একটি মুহুর্ত বসে রয়েছে ! বাগানের চার দিকে তারা সব ঘিরে রয়েছে । তারা কি আমাকে দেখে আজ চিনতে পারছে ? অপরিচিত লোকের মতো আমাকে তারা কি আজ কৌতুহলদৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে! এমন এক কাল গিয়েছে, যখন প্রতিদিন আমি এই বাগানে আসতুম, গাছপালাগুলি প্রতিদিন আমার জন্যে যেন অপেক্ষা ক’রে থাকত, আমি এলে আমাকে যেন এসে এসো বলে ডাকত । আজ কি তারা আর আমাকে সে রকম ক'রে ডাকছে ? তারা হয়ত বলছে, তুমি কে এখেনে এলে ?