পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ V30: তৃতীয় “দেখো, সন্দু, এবারে আমি তোমার শরণাপন্ন ।” সদু বললে, “কবে তুমি আমার শরণাপন্ন নও, শুনি । এইজনা তো তোমাকে সবাই ন্ত্রৈণ বলে। দু জাতের স্ত্ৰৈণ আছে। এক দল পুরুষ স্ত্রীর জোরের কাছে হার না মেনে থাকতে পারে না, তারা কাপুরুষ। আর-এক দল আছে তারা সত্যিকার পুরুষ, তাই তারা স্ত্রীর কাছে অসংশয়ে হার মেনেই নেয়। তারা অবিশ্বাস করতে জানেই না, কেননা তারা বড়ো । এই দেখো-না। আমার কত বড়ো সুবিধে- তােমাকে যখন খুশি যেমন খুশি ঠকাতে পারি, তুমি চােখ বুজে। সব নাও।” “সন্দু, কী পষ্ট পষ্ট তোমার কথাগুলি গো ।” “সে তোমারই গুণে কর্তা, সে তোমারই গুণে ।” ‘এবারে কাজের কথাটা শুনে নাও- ও-সব আলোচনা পরে হবে । এবারে একটা সরকারী কাজে তোমার সাহায্য চাই। নইলে আমার আর মান থাকে না । পুলিসের লোেকরা নিশ্চয়ই জেনেছে। এই কাছাকাছি কোথায় এক জায়গায় একজন মেয়ে আছে । সেই এখানকার খবর কেমন করে পায় আর ওকে সাবধানে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায় । সে আচ্ছা জাহাবাজ মেয়ে । ওরা বলছে সে এই পাড়ারই কোনো বিধবা মেয়ে। যেমন করে হােক তার সন্ধান নিয়ে তার সঙ্গে তোমাকে ভাব করতে হবে ।” সদু বললে, “শেষকালে আমাকেও তোমাদের চরের কাজে লাগবে !! আচ্ছ, তাই হবে, মেয়েকে দিয়ে মেয়ে ধরার কাজে লাগা যাবে, নইলে তোমার মুখ রক্ষা হবে না । আমি এই ভার নিলুম | দুদিনের মধ্যে সমস্ত রহস্য ভেদ হয়ে যাবে।” “পরশু হল শিবরাত্রি, খবর পেয়েছি অনিল-ডাকাত সিদ্ধেশ্বরী তলার মন্দিরে জপতপ করে রাত কাটাবে । তার মনে তো ভয়-ডর কোথাও নেই। এ দিকে ও ভারি ধামিক কিনা, ও মেয়েটা থাকবে তার কিরকম তান্ত্রিক মতের স্ত্রী হয়ে ।” “তোমরা পুলিসের লোক আড়ালে আড়ালে থেকে, আমি ধরে দেব ! কিন্তু রাত্রি একটার আগে যেয়ো না । তাড়াহুড়ো করলে সব ফসকে যাবে ।” অমাবস্যার রাত, একটা বেজেছে । পায়ের-জুতো-খোলা দুটাে একটা লোক অন্ধকারে নিঃশব্দে এ দিকে ও দিকে বেড়াচ্ছে । বিজয়বাবু মন্দিরের দরজার কাছে । একজন চুপিচুপি তাকে ইশারা করে ডাকলে, আস্তে আস্তে বললে, “সেই ঠাকরুনটি আজ মন্দিরের মধ্যে এসেছেন তাতে সন্দেহমাত্র নেই । তিনি বিখ্যাত কোনো যোগিনী ভৈরবী । দিনের বেলা কারও চোখেই পড়েন না। রাত্রি একটার পর শুনেছি নটরাজের সঙ্গে তার নৃত্য । একটা লোক দৈবাৎ দেখেছিল, সে পাগল হয়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে । হুজুর, আমরা মন্দিরে গিয়ে ঐ ঠাকরুনের গায়ে হাত দিতে পারব না। এমন-কি, চােখে দেখতেও পারব না- এ বলে রাখছি। আমরা ব্যারাকে ফিরে যাব ঠিক করেছি। আপনি একলা যা পারেন করবেন।” একে একে তারা সবাই চলে গেল। নিঃশব্দ– বিজয়বাবু যত বড়ো একেলে লোক হােন-না কেন, তীর যে ভয় করছিল না। এ কথা বলা যায় না। তার বুক দূরদূর করছে তখন। দরজার কাছ থেকে মেয়েলি গলায় গুন গুন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ; ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতাগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং । বিজয়ের গায়ে কঁাটা দিয়ে উঠতে লাগল। ভাবলেন কী করা যায। এক সময়ে সাহসে ভর করে দিলেন দরজায় ধাক্কা। ভাঙা দরজা খুলে গেল। ভিতরে একটি মাটির প্রদীপ মিটমিটু করে জ্বলছে, দেখলেন শিবলিঙ্গের সামনে তার স্ত্রী জোড়হাত করে বসে, আর অনিল এক পাশে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। নিজের স্ত্রীকে দেখে সাহস হল মুনে,বললেন—“সদু, অবশেষে তােমার এই কাজ।” ইয়া, আমিই সেই মেয়ে যাকে তোমরা এতদিন খুঁজে বেড়ােচ্ছ। নিজের পরিচয় দেব বলেই আজ