পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

αO রবীন্দ্র-রচনাবলী সে মনে-মনে জ্বলে পুড়ে মরে। সূরীতির এই দুৰ্গতিতে দয়া হয় এমন পুরুষও ছিল ওদের মধ্যে, কিন্তু তারা ঠাই পায় না । আর-একদিন হঠাৎ কী খেয়াল গেল, যখন সুরীতি কলেজে আসছিল তখন রাস্তার ওপর থেকে নীহার তাকে ডেকে উঠল- “হে কনকচম্পকদামগীেরী !” লোকটা পড়াশুনা করেছে বিস্তর, তার ভাষা শিখবার যেন একটা নেশা ছিল। যখন তখন অকারণে সংস্কৃত আওড়াত, তার ধ্বনিটা লাগত ভালো। পাঠ্য পুস্তকের পড়ায় সুরীতি তাকে এগিয়ে থাকত, মুখস্থ বিদ্যেয় সে ছিল ওস্তাদ। কিন্তু পাঠ্যের বাইরে ছিল নীহারের প্রচুর পড়াশুনা। সূরীতি একেবারে প্রায় কঁদোকাদো হয়ে ছুটে গোবিন্দবাবুর ঘরে গিয়ে বললে, “রাস্তায় ঘাটে এরকম সম্ভাষণ। আমার সহ্য श नां ।” নীহার বললে, “আমার অন্যায় হয়েছে। কাল থেকে ওকে বলব “মসীপুঞ্জিতবর্ণা, কিন্তু সেটা কি বড় বেশি রিয়ালিস্টিক হবে না ।” সূরীতি প্রায় কঁদিতে কঁদিতে ছুটে গেল। নীহারের চরিত্রে একটা নিরেট নিষ্ঠুরতা ছিল। যথোপযুক্ত ঘুষ দিয়ে তবে সেটাকে শান্ত করা যেত । এ কথা সবাই জানে । একদিন নীহার জাপানি খেলনা- কটুকটে-আওয়াজ করা কাঠের ব্যাঙ দিয়ে ছেলেদের পকেট ভর্তি করে আনলে । ঠিক যে সময়ে প্লেটোর দার্শনিকতত্ত্ব ব্যাখ্যা করবার পালা এল- সমস্ত ক্লাসে কটুকটু কটুকটু শব্দ পড়ে গেল। শব্দটা যে কোথা থেকে হচ্ছে তাও স্পষ্ট বোঝা শক্ত। সেদিন কটুকটে ব্যাঙের শব্দে প্লেটাের কণ্ঠ একেবারে ডুবে গেল। শেষকালে খানাতল্লাসি করে দেখা গেল, দশটা কাঠের ব্যাঙ। সূরীতির ডেস্কের ভিতরে । সে চীৎকার করে বলে উঠল, “এ কখনো আমার নয়। অন্যরা কেউ আমার ডেস্কে দুষ্টুমি করে ভরে রেখেছে।” ছেলেরা মহা তেরিয়া হয়ে বলে উঠল, “আমাদের উপর এরকম অন্যায় দোষ দিলে আমরা সইতে দুঃক্ষে ফলপ্সৰ লোকৰ শৰ কালপুরুষল হাইপারেন এ-সমস্ত মেয়েদেরই "ן কিছুক্ষণ ক্লাসঘর নীরব । তার পরে হঠাৎ অপর কোণ থেকে অদ্ভুত শব্দ উঠল, একসঙ্গে সব ছেলেরা পা ঘষতে শুরু করেছে সিমেন্টের উপর। এতগুলো জুতো ঘষার শব্দে একটা উৎকট কনসার্টের সৃষ্টি হল। ক্রমশ মাত্রা ছাড়িয়ে গেল, সুরীতির পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকা চলল না ; কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে রইল, এক সময়ে হঠাৎ দাঁড়াম করে একটা শব্দ হওয়ার পর ছেলেরা উঃ হুঃ শব্দে সানাইয়ের আওয়াজ নকল করতে লাগিল । r তখন সুরীতি বলে উঠল, “সার, অনুগ্রহ করে ওদের গোলমাল করতে বারণ করবেন কি ! আমরা এখানে পড়তে এসেছি, কিন্তু সংগীতচর্চার জায়গা এটা নয় । যদি কারও ক্লাস করতে ইচ্ছে না হয়, তবে ক্লাস ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত ।” সঙ্গে সঙ্গে চার দিক থেকে রব উঠল, “শেম, 'শেম এবং লেফট রাইট মার্চ করতে করতে ছেলেরা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে । সেদিনকার মতো ক্লাস আর জমল না। মেয়েরা যখন ক্লাস থেকে বেরিয়ে কমনরুমে বসেছে, একটি পিয়ন এসে খবর দিল- সূরীতিকে সেক্রেটারিবাবু ডেকেছেন। মেয়েরা সব কানাকানি করতে লাগল। সূরীতি সেক্রেটারির ঘরে ঢুকে দেখলে সেখানে তাদের সেদিনকার করেছে তোমার আজকের ব্যবহারে তারা অপমান বোধ করেছে। তোমার দিক থেকে যদি কিছু বলবার থাকে তো বলে।” সূরীতি বললে, “সার, ওরা যে প্রফেসারের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহার করল, আমাদের সঙ্গে অভদ্রতা করল, তাতে কি আমাদেরই অপমান হয় না ।”