পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ8: রবীন্দ্র-রচনাবলী । প্ৰশংসা করতে লাগল। প্ৰগতিসংঘ থেকে সে নিজেই আপনার নাম কাটিয়ে নিলে । তাদের পড়ানো চলে কি না । নীহার বললে, না, তাও চলে না । তার ফল হল সে অর্ধেক মাইনে স্বীকার করে মাস্টারি নিয়ে বললে, তার বাকি বেতন থেকে ছেলেদের আলাদা পড়বার লোক রাখা হােক। স্কুলের সেক্রেটারিবাবু অবাক । সুব্রীতির মনের টান ক্রমশ দুঃসহ হয়ে উঠতে লাগল। এক সময়ে কোনোরকম করে আভাস দিয়েছিল, তাদের বিয়ে হতে পারে কি না। একদিন যে সমাজের নিয়মকে সুব্রীতি মানত না, সেই সমাজের নিয়ম অনুসারে শুনতে পেল ওদের বিয়ে হতে পারে না কোনােমতেই। অথচ এই পুরুষের আনুগত্য রক্ষা করে চিরকাল মাথা নিচু করে চলতে পারে তাতে অপরাধ নেই, কেননা বিধাতার সেই বিধান । প্রায়ই সে শুনতে পেত- নীহারের অবস্থা ভালো নয়, পড়বার বই তাকে ধার করে পড়তে হয় । তখন সুরীতি নিজের জলপানি থেকে ওকে যথেষ্ট সাহায্য করতে লাগল। নীহারের তাতে কোনাে লজ্জা ছিল না। মেয়েদের কাছ থেকে পুরুষদের যেন অর্ঘ্য নেবার অধিকার আছে। অথচ তার বিদ্যার অভিমানের অন্ত ছিল না। একবার একটি কলেজে বাংলা অধ্যাপকের পদ খালি ছিল। সূরীতির অনুরোধে নীহারকে সে পদে গ্রহণ করবার প্রস্তাবে অনুকুল আলোচনা চলছিল। তাতে নীহারের নাম নিয়ে কমিটিতে এই আলোচনায় তার অহংকারে ঘা লাগল । সুব্রীতি নীহারকে বললে, “এ তোমার অন্যায় অভিমান। স্বয়ং ভাইসরয় নিযুক্ত করবার সময়েও কাউন্সিলের মেম্বারদের মধ্যে তা নিয়ে কথাবার্তা চলে ।” । নীহার বললে, “তা হতে পারে, কিন্তু আমাকে যেখানে গ্রহণ করবে। সেখানে বিনা তর্কেই গ্ৰহণ করবে। এ না হলে আমার মান বঁাচবে না । আমি বাংলা ভাষায় এম. এ তে সব-প্রথম পদবী পেয়েছি। আমি অমন করে কমিটি থেকে বঁট দিয়ে নেওয়া পদ নিতে পারব না ।” এ পদ যদি নিত তা হলে সুব্রীতির কাছ থেকে অর্থসাহায্যের প্রয়োজন চলে যেত নীহারের। পদকে সে অগ্রাহ্য করলে, কিন্তু এই প্রয়োজনকে না । সুব্রীতির জলখাবার প্রায় বন্ধ হয়ে এল। বাড়ির লোকে ওর ব্যবহারে এবং চেহারায় অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে উঠল। ছেলেবেলা থেকেই ওর শরীর ভালো নয়, তার উপরে এই কষ্ট করা- এ তপস্যা কার জন্য সে কথা যখন তারা ধরতে পারলে তখন তারা নীহারকে গিয়ে বললে, “হয় তুমি একে বিবাহ করো, নয় এর সঙ্গ ত্যাগ করো ।” নীহার বললে, “বিবাহ করা তো চলবেই না- আর ত্যাগের কথা আমাকে বলছেন কেন, সঙ্গ ইচ্ছে করলেই তো তিনি ত্যাগ করতে পারেন, আমার তাতে কিছুমাত্র আপত্তি নেই।” সূরীতি সে কথা জানত। সে জানত নীহারের কাছে তার কোনো মূল্যই নেই, নিজের সুবিধাটুকু ছাড়া। সেই সুবিধাটুকু বন্ধ হলে তাকে অনায়াসে পথের কুকুরের মতো খেদিয়ে দিতে পারে। এ জেনেও যতরকম পারে সুবিধে দিয়ে, বই কিনে দিয়ে, নতুন খন্দরের থান তাকে উপহার দিয়ে, যেমন করে পারে তাকে এই সুবিধার স্বার্থবিন্ধনে বেঁধে রাখলে । অন্য গতি ছিল না বলে এই অসম্মান সুরীতি স্বীকার করে নিলে । এক সময়ে মফস্বলে বেশি মাইনের প্রিন্সিপালের পদ পেয়েছিল । তখন তার কেবল এই মনের ভিতরে বাজত, “আমি তো খুব আরামে আছি, কিন্তু তিনি তো ওখানে গরিবের মতো পড়ে থাকেনএ আমি সহ্য করব কী করে।’ অবশেষে একদিন বিনা কারণে কাজ ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় অল্প বেতনে এক শিক্ষয়িত্রীর পদ নিলে । সেই বেতনের বারো-আনা যেত নীহাররঞ্জনের পেট ভরাতে, তার শখের জিনিস কিনে দিতে। এই ক্ষতিতেই ছিল তার আনন্দ । সে জানত মন ভোলাবার কোনাে বিদ্যো তার জানাই ছিল না । এই কারণেই তার ত্যাগ এমন অপরিমিত হয়ে উঠল । এই ত্যাগেই সে অনা