পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ዓዓ কমলা ছিল সুন্দরী, তার বাপ মা গিয়েছিল মারা, সেইসঙ্গে সেও বিদায় নিলেই পরিবার নিশ্চিন্ত হত। কিন্তু তা হল না, তার কাকা বংশী অত্যন্ত স্নেহে অত্যন্ত সতর্কভাবে এতকাল তাকে পালন করে qርቫር፪ | তার কাকি কিন্তু প্রতিবেশিনীদের কাছে প্রায়ই বলত, “দেখ তো ভাই, মা বাপ ওকে রেখে গোল কেবল আমাদের মাথায় সর্বনাশ চাপিয়ে । কোন সময় কী হয় বলা যায় না। আমার এই ছেলেপিলের ঘর, তারই মাঝখানে ও যেন সর্বনাশের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে, চারি দিক থেকে কেবল দুষ্টলোকের দৃষ্টি এসে পড়ে। ঐ একলা ওকে নিয়ে আমার ভরাডুবি হবে কোনদিন, সেই ভয়ে আমার ঘুম হয় " এতদিন চলে যাচ্ছিল একরকম করে, এখন আবার বিয়ের সম্বন্ধ এল। সেই ধুমধামের মধ্যে আর তো। ওকে লুকিয়ে রাখা চলবে না। ওর কাকা বলত, “সেইজন্যই আমি এমন ঘরে পাত্র সন্ধান করছি যারা মেয়েকে রক্ষা করতে পারবে ।” ছেলেটি মোচাখালির পরমানন্দ শেঠের মেজো ছেলে । অনেক টাকার তবিল চেপে বসে আছে, বাপ ম'লেই তার চিহ্ন পাওয়া যাবে না । ছেলেটি ছিল বেজায় শৌখিন— বাজপাখি উড়িয়ে, জুয়ো খেলে, বুলবুলের লড়াই দিয়ে খুব বুক ঠুকেইটাকা ওড়াবার পথ খোলসা করেছিল। নিজের সম্পদের গর্ব ছিল তার খুব, অনেক ছিল মাল। মোটামোটা ভোজপুরী পালোয়ান ছিল, সব বিখ্যাত লাঠিয়াল । সে বলে বেড়াত, সমস্ত তল্লাটে কোন ভগ্নীপতির পুত্র আছে যে ওর গায়ে হাত দিতে পারে। মেয়েদের সম্বন্ধে সে ছেলেটি বেশ একটু শৌখিন ছিল- তার এক স্ত্রী আছে আর একটি নবীন বয়েসের সন্ধানে সে ফিরছে। কমলার রূপের কথা তার কানে উঠল। শেঠবংশ খুব ধনী, খুব প্রবল। ওকে ঘরে নেবে এই হল তাদের পণ । কমলা কেঁদে বলে, “কাকামণি, কোথায় আমাকে ভাসিয়ে দিচ্ছি।” “তোমাকে রক্ষা করবার শক্তি থাকলে চিরদিন তোমাকে বুকে করে রাখতুম জানো তো মা !” বিবাহের সম্বন্ধ যখন হল তখন ছেলেটি খুব বুক ফুলিয়ে এল আসরে, বাজনাবাদি সমারোহের অন্ত ছিল না। কাকা হাত জোড় করে বললে, “বাবাজি, এত ধুমধাম করা ভালো হচ্ছে না, সময় খুব খারাপ ।” শুনে সে আবার ভগ্নীপতির পুত্রদের আস্পর্ধা করে বললে, “দেখা যাবে কেমন সে কাছে ঘেঁষে।” কাকা বললে, “বিবাহ-অনুষ্ঠান পর্যন্ত মেয়ের দায় আমাদের, তার পর মেয়ে এখন তোমার- তুমি ওকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছবার দায় নাও । আমরা এ দায় নেবার যোগ্য নই, আমরা দুর্বল।” ও বুক ফুলিয়ে বললে, “কোনো ভয় নেই।” ভোজপুরী দারোয়ানরা গোফ চাড়া দিয়ে দাড়ালে সব লাঠি হাতে । কন্যা নিয়ে চললেন বর সেই বিখ্যাত মাঠের মধ্যে, তালতড়ির মাঠ। মধুমোল্লার ছিল ডাকাতের সর্দার । সে তার দলবল নিয়ে রাত্রি যখন দুই প্রহর হবে, মশাল জ্বালিয়ে হাক দিয়ে এসে পড়ল। তখন ভোজপুরীদের বড়ো কেউ বাকি রইল না। মধুমোল্লার ছিল বিখ্যাত ডাকাত, তার হাতে পড়লে পরিত্রাণ নেই। কমলা ভয়ে চতুর্দােলা ছেড়ে ঝোপের মধ্যে লুকোতে যাচ্ছিল এমন সময় পিছনে এসে দাড়ালো বৃদ্ধ হবির খা, তাকে সবাই পয়গম্বরের মতোই ভক্তি করত । হবির সোজা দাড়িয়ে বললে, “বাবাসকল তফাত যাও, আমি হবির ধা।” - ডাকাতরা বললে, “খা সাহেব, আপনাকে তো কিছু বলতে পারব না। কিন্তু আমাদের ব্যাবসা মাটি করলেন কেন ।” যাই হােক তাদের ভঙ্গ দিতেই হল । হবির এসে কমলাকে বললে, “তুমি আমার কন্যা । তোমার কোনো ভয় নেই, এখন এই বিপদের