পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ O ক্রমে রাত্রি বাড়িতে লাগিল। কঁাদিয়া কঁাদিয়া দুর্বল বিধবা ক্লান্ত হইয়া গিয়াছেন, নিজীবিভাবে শয্যায় পডিয়া আছেন, এমন সময়ে বাহিরে পদশব্দ শুনা গেল। বিধবা চিকিত নেত্ৰে দ্বারের দিকে চাহিয়া ক্ষীণস্বরে ‘কহিলেন, “কমল, মা, আইলি ?” একজন বাহির হইতে রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “ঘরে কে আছে।” -- গৃহ হইতে কমলের মাতা উত্তর দিলেন। সে শাখাদীপ’ হস্তে গৃহে প্রবেশ করিল এবং কমলের মাতাকে কী কহিল, শুনিবামাত্র বিধবা চীৎকার করিয়া মুছিত হইয়া পড়িলেন। এ দিকে তুষার ক্লিষ্ট কমল ক্ৰমে-ক্রমে চেতন লাভ করিল, চক্ষু মেলিয়া চাহিল। দেখিল— একটি প্ৰকাণ্ড গুহা, ইতস্তত বৃহৎ শিলাখণ্ড বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে, গাঢ় ধূম্র মেঘে গুহা পূর্ণ, সেই মেঘের অন্ধকার ভেদ করিয়া শাখাদীপের আলোকদীপ্ত কতকগুলি কঠোর শ্মশ্রুপূর্ণ মুখ কমলের মুখের দিকে চাহিয়া আছে। প্রাচীরে কুঠার কৃপাণ প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্ৰ লম্বিত আছে, কতকগুলি সামান্য গাৰ্হস্থ্যু উপকরণ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত । বালিকা সভয়ে চক্ষু নিমীলিত করিল। আবার চক্ষু মেলিয়া চাহিল। একজন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি।” বালিকা উত্তর দিতে পারিল না, বালিকার বাহু ধরিয়া সবেগে নাড়াইয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুই ।” কমল ভীতিকম্পিত মৃদুস্বরে কুহিল, “আমি কমল।” সে মনে করিয়াছিল। এই উত্তরেই তাঁহারা তাহার সমস্ত পরিচয় পাইবে । । একজন জিজ্ঞাসা করিল, “আজ সন্ধ্যার দুর্যোগের সময় পথে ভ্ৰমণ করিতেছিলে কেন ।” বালিকা আর থাকিতে পারিল না, কাদিয়া উঠিল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, “আজ আমার মা সমস্ত-দিন আহার করিতে পান নাই—” সকলে হাসিয়া উঠিল— তাহাদের নিষ্ঠুর অট্টহাস্যে গুহা প্ৰতিধ্বনিত হইল, বালিকার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল, কমল সভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করিল। দসু্যদের হাস্য বজধ্বনির ন্যায় বালিকার বক্ষে গিয়া বাজিল ; সে সভয়ে কাদিয়া উঠিয়া কহিল, “আমাকে আমার মায়ের কাছে লইয়া যাও ।” পিতামাতার নাম, প্রভৃতি জানিয়া লইল । অবশেষে একজন কহিল, “আমরা দসু্য, তুই আমাদের বন্দিনী । তোর মাতার নিকট বলিয়া পাঠাইতেছি, সে যদি নির্ধারিত অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না দেয় তবে তোকে মারিয়া ফেলিব ।” কমল কঁদিয়া কহিল, “আমার মা অর্থ কোথায় পাইবেন । তিনি অতি দরিদ্র। র্তাহার আর কেহ নাই— আমাকে মারিয়ো না, আমাকে মারিয়ো না, আমি কাহারও কিছু করি নাই।” আবার সকলে হাসিয়া উঠিল । কমলের মাতার নিকটে একজন দূত প্রেরিত হইল। সে গিয়া কহিল, “তােমার কন্যা বন্দিনী হইয়াছে— আজ হইতে তৃতীয় দিবসে আমি আসিব- যদি পাচশত মুদ্রা দিতে পারে। তবে মুক্ত করিয়া দিব, নচেৎ তোমার কন্যা নিশ্চিত হত হইবে।” এই সংবাদ শুনিয়াই কমলের মাতা মুছিত হইয়া পড়েন। দরিদ্র বিধবা অর্থ পাইবেন কোথায় । একে একে সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন। বিবাহ হইলে কমলকে দিবেন বলিয়া কতকগুলি অলংকার রাখিয়া দিয়াছিলেন, সেগুলি বিক্রয় করিলেন । তথাপি নির্দিষ্ট অর্থের চতুর্থাংশও হইল না। আর কিছুই নাই। অবশেষে বক্ষের বস্ত্ৰ মোচন করিলেন, সেখানে তাহার মৃত স্বামীর একটি অঙ্গুরীয়ক রাখিয়া দিয়াছিলেন- মনে করিয়াছিলেন, সুখ হউক, ১ পার্বত্য লোক চীড়েবৃক্ষের শাখা জ্বালাইয়া মশালের ন্যায় ব্যবহার করে ।