পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী وسط শুনিলেন, স্বামীর আলয়ে । মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। তিনি কত কী আশা করিয়াছিলেন— ভাবিয়াছিলেন কত দিনের পর দেশে ফিরিয়া যাইতেছেন, যুদ্ধের উন্মত্ত ঝটিকা হইতে প্ৰণয়ের শান্তিময় স্নিগ্ধ নীড়ে ঘুমাইতে যাইতেছেন, তিনি যখন অতর্কিতভাবে দ্বারে গিয়া দাড়াইবেন তখন হৰ্ষবিহবলা কমল ছুটিয়া গিয়া তাহার বক্ষে বঁপাইয়া পড়িবে। বাল্যকালের সুখময় স্থান সেই শৈলশিখরের উপর বসিয়া কমলকে যুদ্ধ-গৌরবের কথা শুনাইবেন, অবশেষে কমলের সহিত বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়া প্ৰণয়ের কুসুমকুঞ্জে সমস্ত জীবন সুখের স্বপ্নে কাটাইবেন। এমন সুখের কল্পনায় যে কঠোর বজ্ৰ পড়িল, তাহাতে তিনি দারুণ অভিভূত হইয়া পড়িলেন। কিন্তু মনে তঁাহার যতই তোলপাড় হইয়াছিল, প্রশান্ত মুখশ্ৰীতে, একটিমাত্র রেখাও পড়ে নাই । মোহন কমলকে তাহার মাতৃ-আলয়ে রাখিয়া বিদেশে চলিয়া গেলেন। পঞ্চদশ বর্ষ বয়সে কমল-পুস্পকলিকাটি ফুটিয়া উঠিল। ইহার মধ্যে কমল একদিন বকুলবনে মালা গাঁথিতে গিয়াছিল, কিন্তু পারে নাই, দূর হইতেই শূন্যমনে ফিরিয়া আসিয়াছিল। আর-একদিন সে বাল্যকালের খেলেনাগুলি বাহির করিয়াছিল— আর খেলিতে পারিল না, নিরাশার নিশ্বাস ফেলিয়া সেগুলি তুলিয়া রাখিল। অবলা ভাবিয়ছিল যে, যদি অমর ফিরিয়া আসে। তবে আবার দুইজনে মালা গাঁথিবে, আবার | দুইজনে খেলা করিবে। কতকাল তাহার বাল্যাসখা অমরকে দেখিতে পায় নাই, মর্মপীড়িতা কমল এক-একবার যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া উঠিত। এক-একদিন রাত্রিকালে গৃহে কমলকে কেহ দেখিতে পাইত না, কমল কোথায় হারাইয়া গিয়াছে- খুঁজিয়া খুঁজিয়া অবশেষে তাহার বল্যের ক্ৰীড়াস্থল সেই শৈলশিখরের উপর গিয়া দেখিত- মানবদনা বালিকা অসংখ্যতারাখচিত অনন্ত আকাশের পানে নেত্র পাতিয়া আলুলিতকেশে শুইয়া আছে। কমল মাতার জন্য, অমরের জন্য কাদিত বলিয়া মোহন বড়েই রুষ্ট হইয়াছিল এবং তাহাকে মাতৃ-আলয়ে পঠাইয়া ভাবিয়ছিল যে, ‘দিনকতক অর্থাভাবে কষ্ট পাক, তাহার পরে দেখিব কে কাহার জন্য কাদিতে পারে ।” - মাতৃভবনে কমল লুকাইয়া কঁদে । নিশীথবায়ুতে তাহার কত বিষাদের নিশ্বাস, মিশাইয়া গিয়াছে, বিজন শয্যায় সে যে কত অশ্রাবারি মিশাইয়াছে, তাহা তাহার মাতা একদিনও জানিতে পারেন নাই। একদিন কমল হঠাৎ শুনিল তাহার অমর দেশে ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহার কত দিনকার কত কী ভােব উথলিয়া উঠিল। অমরসিংহের বাল্যকালের মুখখানি মনে পড়িল। দারুণ যন্ত্রণায় কমল কতক্ষণ কাদিল । অবশেষে অমরের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত বাহির হইল । সেই শৈলশিখরের উপরে সেই বকুলতরুচ্ছায়ায় মর্মাহত অমর বসিয়া আছেন। এক-একটি করিয়া ছেলেবেলাকার সকল কথা মনে পড়িতে লাগিল। কত জ্যোৎস্না-রাত্রি, কত অন্ধকার সন্ধ্যা, কত বিমল উষা, অস্ফুট স্বপ্নের মতো তাহার মনে একে একে জাগিতে লাগিল। সেই বাল্যকালের সহিত র্তাহার ভবিষ্যৎ জীবনের অন্ধকারময় মরুভূমির তুলনা করিয়া দেখিলেন- সঙ্গী নাই, সহায় নাই, আশ্রয় নাই, কেহ ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিবে না, কেহ তাহার মর্মের দুঃখ শুনিয়া মমতা প্রকাশ করিবে না- অনন্ত আকাশে কক্ষচ্ছিন্ন জ্বলন্ত ধূমকেতুর ন্যায়, তরঙ্গাকুল অসীম সমুদ্রের মধ্যে ঝটিকাতাড়িত একটি ভগ্ন ক্ষুদ্র তরণীর ন্যায়, একাকী নীরব সংসারে উদাস হইয়া বেড়াইবেন । । ক্ৰমে দূর গ্রামের কোলাহলের অস্ফুট ধ্বনি থামিয়া গেল, নিশীথের বায়ু আঁধার বকুলকুঞ্জের পত্ৰ মর্মরিত করিয়া বিষাদের গভীর গান গাহিল। অমর গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে, শৈলের সমুচ্চ শিখরে একাকী বসিয়া দূর নির্বারের মৃদু বিষন্ন ধ্বনি, নিরাশ হৃদয়ের দীর্ঘনিশ্বাসের ন্যায় সমীরণের হু-হু শব্দ, এবং নিশীথের মর্মভেদী একতানবাহী যে-একটি গভীর ধ্বনি আছে, তাহাই শুনিতেছিলেন। তিনি দেখিতেছিলেন অন্ধকারের সমুদ্রতলে সমস্ত জগৎ ডুবিয়া গিয়াছে, দূরস্থ শ্মশানক্ষেত্রে দুই-একটি চিন্তানল জ্বলিতেছে, দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত নীরন্ধ স্তম্ভিত মেঘে আকাশ অন্ধকার । ,