পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se brዓ সহসা শুনিলেন উচ্ছসিত স্বরে কে কহিল, “ভাই অমর”-- এই অমৃতময়, স্নেহময়, স্বপ্নময় স্বর শুনিয়া তাহার স্মৃতির সমুদ্র আলোড়িত হইয়া উঠিল। ফিরিয়া দেখিলেন- কমল। মুহুর্তের মধ্যে নিকটে আসিয়া বাহুপাশে তাহার গলদেশ বেষ্টন করিয়া স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া কহিল, “ভাই অমর”- আচলহাদয় অমরও অন্ধকারে অশ্রু বিসর্জন করিলেন, আবার সহসা চকিতের ন্যায় দূরে সরিয়া গেলেন । কমল অমরকে কত কী কথা বলিল, অমর কমলকে দুই-একটি উত্তর দিলেন। সরলা আসিবার সময়ে যেরূপ উৎফুল্লাহৃদয়ে হাসিতে হাসিতে আসিয়াছিল যাইবার সময় সেইরূপ ত্ৰিয়মাণ হইয়া কঁদিতে কঁাদিতে চলিয়া গেল । কমল কাল হইতে আবার খেলা করিতে আরম্ভ করিব । যদিও অমর মর্মের গভীরতলে সাংঘাতিক আহত হইয়াছিলেন, তথাপি তিনি কমলের উপর কিছুই ক্রুদ্ধ হন নাই বা অভিমান করেন নাই। র্তাহার জন্য বিবাহিতা বালিকার কর্তব্যকর্মে বাধা না পড়ে এই নিমিত্ত তিনি তাহার পরদিন কোথায় যে চলিয়া গেলেন তাহা কেহই স্থির করিতে পারিল না । বালিকার সুকুমার হৃদয়ে দারুণ বজ্ৰ পড়িল। অভিমানিনী কতদিন ধরিয়া ভাবিয়াছে যে, এত দিনের পর সে বাল্যাসখা অমরের কাছে ছুটিয়া গেল, অমর কেন তাহাকে উপেক্ষা করিল। কিছুই ভাবিয়া পায় নাই। একদিন তাহার মাতাকে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, মাতা তাহাকে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে, কিছুকাল রাজসভার আড়ম্বর-রাশির মধ্যে থাকিয়া সেনাপতি অমরসিংহ পর্ণকুটিরবাসিনী ভিখারিনী ক্ষুদ্র বালিকাটিকে ভুলিয়া যাইবেন তাহাতে অসম্ভব কী আছে। এই কথায় দরিদ্র বালিকায় অন্তরতম দেশে শেল বিধিয়াছিল। অমরসিংহ তাহার প্রতি নিষ্ঠুরাচরণ করিল মনে করিয়া কমল কষ্ট পায় নাই। হতভাগিনী ভাবিত, “আমি দরিদ্র, আমার কিছুই নাই, আমার কেহই নাই, আমি বুদ্ধিহীনা ক্ষুদ্র বালিকা, তাহার চরণরেণুরও যোগ্য নহি, তবে তঁহাকে ভাই বলিব কোন অধিকারে । তঁহাকে ভালোবাসিব কোন অধিকারে। আমি দরিদ্র কমল, আমি কে যে তাহার স্নেহ প্রার্থনা করিব।” সমস্ত রাত্রি কাদিয়া কাটিয়া যায়, প্রভাত হইলেই সেই শৈলশিখরে উঠিয়া ত্ৰিয়মাণ বালিকা কত কী ভাবিতে থাকে, তাহার মর্মের নিভৃত তলে যে বাণ বিদ্ধ হইয়াছিল তাহা যদিও সে মর্মেই লুকাইয়া য়াছিল— পৃথিবীর কাহাকেও দেখায় নাই- তথাপি ঐ মর্মে-লুক্কায়িত বাণ ধীরে ধীরে তাহার হৃদয়ের শোণিত ক্ষয় করিতে লাগিল । বালিকা আর কাহারও সহিত কথা কহিত না, মীেন হইয়া সমস্তদিন সমস্তরাত্ৰি ভাবিত। কাহারও সহিত মিশিত না । হাসিত না, কঁাদিত না । এক-একদিন সন্ধ্যা হইলেও দেখা যাইত পথপ্ৰান্তের বৃক্ষতলে মলিন ছিন্ন অঞ্চলে মুখ ঝাপিয়া দীনহীন কমল বসিয়া আছে। বালিকা ক্রমে দুর্বল ক্ষীণ হইয়া আসিতে লাগিল। আর উঠতে পারে না— বাতায়নে একাকিনী বসিয়া থাকিত, দেখিত দূর শৈলশিখরের উপর বকুলপত্র বায়ুভরে কঁাপিতেছে। দেখিত রাখালেরা সন্ধ্যার সময় উদাস-ভাবােদীপক সুরে মৃদু মৃদু গান করিতে করিতে গৃহে ফিরিয়া আসিতেছে। । বিধবা অনেক চেষ্টা করিয়াও বালিকার কষ্ট্রের কারণ বুঝিতে পারেন নাই এবং তাহার রোগের প্রতিকার করিতেও পারেন নাই। কমল নিজেই বুঝিতে পারিত যে, সে মৃত্যুর পথে অগ্রসর হইতেছে। তাহার আর কোনাে বাসনা ছিল না, কেবল দেবতার কাছে প্রার্থনা করিত যে “মরিবার সময় য়েন অমরকে দেখিতে পাই । কমলের পীড়া গুরুতর হইল। মূৰ্ছার পর মূৰ্ছিা হইতে লাগিল। শিয়রে বিধবা নীরব, কমলের গ্রাম্য সঙ্গিনী বালিকার চারি ধার ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দরিদ্র বিধবার অর্থ নাই যে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করিতে পারেন। মােহন দেশে নাই এবং দেশে থাকিলেও তাহার নিকট হইতে কিছু আশা করিতে