পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brክr রবীন্দ্র-রচনাবলী পারিতেন না । তিনি দিবারাত্রি পরিশ্রম করিয়া সর্বস্ব বিক্রয় করিয়া কমলের পথ্যাদি জোগাইতেন । চিকিৎসকদের দ্বারে দ্বারে ভ্ৰমণ করিয়া ভিক্ষা চাহিতেন যে, তাহারা কমলকে একবার দেখিতে আসুক। অনেক মিনতিতে চিকিৎসক কমলকে আজ রাত্রে দেখিতে আসিবে বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। প্রত্যেক গুহায় গুহায় প্রতিধ্বনিত হইতেছে এবং অবিরল বিদ্যুতের তীক্ষা চকিতচ্ছটাি শৈলের প্রত্যেক শৃঙ্গে শৃঙ্গে আঘাত করিতেছে। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে। প্রচণ্ড বেগে ঝটিকা বহিতেছে। শৈলবাসীরা অনেকদিন এরূপ ঝড় দেখেন নাই। দরিদ্র বিধবার ক্ষুদ্র কুটির টলমল করিতেছে, জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া বৃষ্টিধারা গৃহে প্রবাহিত হইতেছে এবং গৃহপার্থে নিম্প্রভ প্রদীপশিখা ইতস্তত কঁাপিতেছে। বিধবা এই ঝড়ে চিকিৎসকের আসিবার আশা পরিত্যাগ করিয়াছেন । হতভাগিনী নিরাশহীদয়ে নিরাশাব্যঞ্জক স্থির দৃষ্টিতে কমলের মুখের পানে চাহিয়া আছেন ও প্রত্যেক শব্দে চিকিৎসকের আশায় চকিত হইয়া দ্বারের দিকে চাহিতেছেন। একবার কমলের মূৰ্ছা ভাঙিল, মূৰ্ছা! ভাঙিয়া মাতার মুখের দিকে চাহিল। অনেকদিনের পর কমলের চক্ষে জল দেখা দিল— বিধবা কঁদিতে লাগিলেন, বালিকারা কাদিয়া উঠিল । সহসা অশ্বের পদধ্বনি শুনা গেল, বিধবা শশব্যাস্তে উঠিয়া কহিলেন চিকিৎসক আসিয়াছেন । দ্বার উদঘাটিত হইলে চিকিৎসক গৃহে প্রবেশ করিলেন। তাহার। আপাদমস্তক বসনে আবৃত, বৃষ্টিধারায় সিক্ত বসন হইতে বারিবিন্দু ঝরিয়া পড়িতেছে। চিকিৎসক বালিকার তৃণশয্যার সম্মুখে গিয়া দাড়াইলেন। অবশ্য বিষাদময় নেত্ৰ চিকিৎসকের মুখের পানে তুলিয়া কমল দেখিল সে চিকিৎসক নয়, সে সেই সীেম্যগন্তীরমূর্তি অমরসিংহ। বিহবলা বালিকা প্ৰেমপূৰ্ণ স্থির দৃষ্টিতে র্তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, বিশাল নেত্ৰ ভরিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল এবং প্রশান্ত হস্যে কমলের বিবৰ্ণ মুখশ্ৰী উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। কিন্তু এই রুগণ শরীরে অত আহলাদ সহিল না। ধীরে ধীরে অশ্রুসিক্ত নেত্ৰ নিমীলিত হইয়া গেল, ধীরে ধীরে বক্ষের কম্পন থামিয়া গেল, ধীরে ধীরে প্রদীপ নিভিয়া গেল। শোকবিহবলা সঙ্গিনীরা বসনের উপর ফুল ছড়াইয়া দিল। অশ্রুহীন নেত্ৰে, দীর্ঘশ্বাস শুন্য বক্ষে, অন্ধকারময় হৃদয়ে, অমরসিংহ ছুটিয়া বাহির হইয়া গেলেন। শোকবিহবলা বিধবা সেই দিন অবধি পাগলিনী হইয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতেন এবং সন্ধ্যা হইলে প্রত্যহ সেই ভগ্নাবশিষ্ট কুটিরে একাকিনী বসিয়া কঁদিতেন। K-9 S Str8 করুণা ভূমিকা গ্রামের মধ্যে অনুপকুমারের ন্যায়। ধন্যবান আর কেহই ছিল না। অতিথিশালানির্মাণ, দেবালয়প্রতিষ্ঠা, পুষ্করিণীখনন প্রভৃতি নানা সৎকর্মে তিনি ধনব্যয় করিতেন। তাহার সিন্ধুক-পূর্ণটাকা ছিল, দেশবিখ্যাত যশ ছিল ও রূপবতী কন্যা ছিল। সমস্ত যৌবনকাল ধন উপার্জন করিয়া অনুপ বৃদ্ধ বয়সে বিশ্রাম করিতেছিলেন। এখন কেবল তাহার একমাত্র ভাবনা ছিল যে, কন্যার বিবাহ দিবেন। কোথায় । সৎপাত্র পান নাই ও বৃদ্ধ বয়সে একমাত্র আশ্রয়স্থল কন্যাকে পরগৃহে পাঠাইতে ইচ্ছা নাই- তজ্জন্যও আজ কাল করিয়া আর তাহার দুহিতার বিবাহ হইতেছে না।