পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ brs সঙ্গিনী-অভাবে করুণার কিছুমাত্র কষ্ট হইত না । সে এমন কাল্পনিক ছিল, কল্পনার স্বপ্নে সে সমস্ত দিন-রাত্রি এমন সুখে কাটাইয়া দিত যে, মুহুর্তমাত্রও তাঁহাকে কষ্ট অনুভব করিতে হয় নাই। তাহার একটি পাখি ছিল, সেই পাখিটি হাতে করিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর পাড়ে কল্পনার রাজ্য নির্মাণ করিত। কাঠবিড়ালির পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটাছুটি করিয়া, জলে ফুল ভাসাইয়া, মাটির শিব গড়িয়া, সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাইয়া দিত। এক-একটি গাছকে আপনার সঙ্গিনী ভগ্নী কন্যা বা পুত্ৰ কল্পনা করিয়া তাহদের সত্য-সত্যই সেইরাপ যত্ন করিত তাহাদিগকে খাবার আনিয়া দিত, মালা পরাইয়া দিত, নানা প্রকার আদর করিত এবং তাদের পাতা শুকাইলে, ফুল ঝরিয়া পড়িলে, অতিশয় ব্যথিত হইত। সন্ধ্যাবেল পিতার নিকট যা-কিছু গল্প শুনিত, বাগানে পাখিটিকে তাহাই শুনানো হইত। এইরূপে করুণা তাহার জীবনের প্রত্যুষাকাল অতিশয় সুখে আরম্ভ করিয়াছিল। তাহার পিতা ও প্রতিবাসীরা মনে করিতেন যে, চিরকালই বুঝি ইহার এইরূপে কাটিয়া যাইবে । কিছু দিন পরে করুণার একটি সঙ্গী মিলিল। অনুপের অনুগত কোনো একটি বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ মরিবার সময় তাহার অনাথ পুত্র নরেন্দ্ৰকে অনুপকুমারের হস্তে সঁপিয়া যান। নরেন্দ্র অনুপের বাটীতে থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করিত, পুত্ৰহীন অনুপ নরেন্দ্রকে অতিশয় স্নেহ করিতেন । নরেন্দ্রের মুখশ্ৰী বড়ো প্রতিজনক ছিল না। কিন্তু সে কাহারও সহিত মিশিত না, খেলিত না ও কথা কহিত না বলিয়া, ভালোমানুষ বলিয়া তাহার বড়োই সুখ্যাতি হইয়াছিল । পল্লীময় রাষ্ট্র হইয়াছিল যে, নরেন্দ্রের মতো শান্ত শিষ্ট সুবোধ বালক আর নাই এবং পাড়ায় এমন বৃদ্ধ ছিল না যে তাহার বাড়ির ছেলেদের প্রত্যেক কাজেই নরেন্দ্রের উদাহরণ উত্থাপন না করিত। - কিন্তু আমি তখনই বলিয়ছিলাম যে, "নরেন্দ্ৰ, তুমি বড়ো ভালো ছেলে নও।” কে জানে নরেন্দ্রের মুখশ্ৰী আমার কোনোমতে ভালো লাগিতা না। আসল কথা এই, অমন বাল্যবৃদ্ধ গভীর সুবোধ শান্ত বালক আমার ভালো লাগে না । অনুপকুমারের স্থাপিত পাঠশালায় রঘুনাথ সার্বভৌম নামে এক গুরুমহাশয় ছিলেন। তিনি নরেন্দ্রকে অপরিমিত ভালোবাসিতেন, নরেন্দ্রকে প্রায় আপনার বাড়িতে লইয়া যাইতেন এবং অনুপের নিকট তাহার যথেষ্ট প্রশংসা করিতেন । এই নরেন্দ্ৰই করুণার সঙ্গী। করুণা নরেন্দ্রের সহিত সেই পুষ্করিণীর পাড়ে গিয়া কাদার ঘর নির্মাণ কিরিত, ফুলের মালা গাথিত এবং পিতার কাছে যে-সকল গল্প শুনিয়াছিল তাঁহাই নরেন্দ্ৰকে শুনাইত, ‘কাল্পনিক বালিকার যত কল্পনা সব নরেন্দ্রের উপর ন্যস্ত হইল । করুণা নরেন্দ্ৰকে এত ভালোবাসিত যে কিছুক্ষণ তাহাকে না দেখিতে পাইলে ভালো থাকিত না, নরেন্দ্ৰ পাঠশালে গেলে সে সেই পাখিটি হাতে করিয়া গৃহদ্বারে দাড়াইয়া অপেক্ষা করিত, দূর হইতে নরেন্দ্ৰকে দেখিলে তাড়াতাড়ি তাহার হাত ধরিয়া সুপ্রিপাড়ে সেইনারিকেল গাছের তলায় আসত, ও তাহার কেরচিত কত কী আৰু কথা শু নরেন্দ্ৰ ক্ৰমে কিছু বড়ো হইলে কলিকাতায় ইংরাজি বিদ্যালয়ে প্রেরিত হইল। কলিকাতার বাতাস লাগিয়া পল্লীগ্রামের বালকের কতকগুলি উৎকট রোগ জন্মিল। শুনিয়াছি স্কুলের বেতন ও পুস্তকাদি ক্রয় করিবার ব্যয় যাহা কিছু পাইত তাহাতে নরেন্দ্রের তামাকের খরচটা বেশ চলিত। প্রতি শনিবারে দেশে যাইবার নিয়ম আছে। কিন্তু নরেন্দ্র তাহার সঙ্গীদের মুখে শুনিল যে, শনিবারে যদি কলিকাতা ছাড়িয়া যাওয়া হয় তবে গলায় দড়ি দিয়া মরাটাই বা কী মন্দ ! বালক বাটীতে গিয়া অনুপকে বুঝাইয়া দিল যে, সপ্তাহের মধ্যে দুই দিন বাড়িতে থাকিলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পরিবে না। অনুপ নরেন্দ্রের বিদ্যাভাসে অনুরাগ দেখিয়া মনে-মনে ঠিক দিয়া রাখিলেন যে, বড়ো হইলে সে ডিপুটি মাজিস্টর হইবে । r তখন দুই-এক মাস অন্তর নরেন্দ্ৰ বাড়িতে আসিত । কিন্তু এ আর সে নরেন্দ্ৰ নহে। পানের পিকে ওষ্ঠাধর প্লাবিত করিয়া, মাথায় চাদর বাধিয়া, দুই পার্থের দুই সঙ্গীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া, কনস্টেবলদের ভীতিজনক যে নরেন্দ্র প্রদোষে কলিকাতার গলিতে গলিতে মারামারি খুঁজিয়া বেড়াইত, ֆ8 ||Գ