পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ । {3న মোটরের শিঙা ফুকতে ফুকতে উত্তেজিত জনতার কেন্দ্রের কাছে গিয়ে দেখি, আমাদের পাড়ার বুড়ো সরকারি মেম্বরটাকে বেদম মারছে। একটু আগেই রাস্তার কলতলায় স্নান সেরে সাফ কাপড় পরে ডান হাতে এক বালতি জল ও বগলে ঝাটা নিয়ে রাস্তা দিয়ে সে যাচ্ছিল। গায়ে চেক-কাটা মেরজাই, জাচড়ানো চুল ভিজে ; বঁ হাত ধরে সঙ্গে চলেছিল আট-নয় বছরের এক নাতি। দুজনকেই দেখতে সুগ্ৰী, সুঠাম দেহ । সেই ভিড়ে কারও সঙ্গে বা কিছুর সঙ্গে তাদের ঠেকাঠেকি হয়ে থাকবে। তার থেকে এই নিরস্তর মারের স্বষ্টি । নাতিটা কাদছে আর সকলকে অনুনয় করছে, "দাদাকে মেরো না।” বুড়োটা হাত জোড় করে বলছে, “দেখতে পাই নি, বুঝতে পারি নি, কস্থর মাফ করে।” অহিংসাত্ৰত পুণ্যার্থীদের রাগ চড়ে উঠছে। বুড়োর ভীত চোখ দিয়ে জল পড়ছে, দাড়ি দিয়ে রক্ত। আমার আর সহ হয় না। ওদের সঙ্গে কলহ করতে নামা আমার পক্ষে অসম্ভব। স্থির করলুম, মেথরকে আমার নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে দেখাব আমি ধার্ষিকদের দলে নই। চঞ্চলত দেখে কলিকা আমার মনের ভাব বুঝতে পারলে। জোর করে আমার হাত চেপে ধরে বললে, “করছ কী, ও ষে মেথর ” আমি বললুম, “হোক-না মেথর, তাই বলে ওকে অন্যায় মারবে ?” কলিকা বললে, “ওরই তো দোষ । রাস্তার মাঝখান দিয়ে যায় কেন। পাশ কাটিয়ে গেলে কি ওর মানহানি হত।” আমি বললুম, “সে আমি বুঝি নে, ওকে আমি গাড়িতে তুলে নেবই।” কলিকা বললে, “তা হলে এখনি এখানে রাস্তায় নেমে যাব । মেথরকে গাড়িতে নিতে পারব না— হাড়িডোম হলেও বুঝতুম, কিন্তু মেথর ” আমি বললুম, “দেখছ-লা, স্বান করে ধোপ-দেওয়া কাপড় পরেছে ? এদের অনেকের চেয়ে ও পরিষ্কার ।” “তা হোক-না, ও যে মেথর ” শোফারকে বললে, “গঙ্গাব্দীন, হাকিয়ে চলে যাও।” আমারই হার হল। আমি কাপুরুষ। নয়নমোহন সমাজতত্ত্বঘটিত গভীর যুক্তি বের করেছিল— সে আমার কানে পৌঁছল না, তার জবাবও দিই নি।