পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর २७१ আমি কিন্তু সবচেয়ে কম করিয়াই বলিতেছি, কেবলমাত্র লিখিতে পড়িতে শেখা । তাহা কিছু লাভ নহে তাহ কেবলমাত্র রাস্তা— সেও পাড়াগায়ের মেটে রাস্ত । আপাতত এই যথেষ্ট, কেননা এই রাস্তাটা ন হইলেই মানুষ আপনার কোণে আপনি বন্ধ হইয়া থাকে। তখন তাহাকে যাত্র-কথকতার যোগে সাংখ্য যোগ বেদান্ত পুরাণ ইতিহাস সমস্তই শুনাইয়া যাইতে পার, তাহার আঙিনায় হরিনামসংকীর্তনেরও ধুম পড়িতে পারে কিন্তু এ কথা তাহার স্পষ্ট বুঝিবার উপায় থাকে না যে, সে একা নহে, তাহার যোগ কেবলমাত্র অধ্যাত্মযোগ নহে, একটা বৃহৎ লৌকিক যোগ । দূরের সঙ্গে নিকটের, অনুপস্থিতের সঙ্গে উপস্থিতের সম্বন্ধপথটা সমস্ত দেশের মধ্যে অবাধে বিস্তীর্ণ হইলে তবেই তো দেশের অনুভবশক্তিটা ব্যাপ্ত হইয়া উঠিবে। মনের চলাচল যতখানি, মানুষ ততখানি বড়ো। মানুষকে শক্তি দিতে হইলে মানুষকে বিস্তৃত করা চাই । g তাই আমি এই বলি, লিখিতে পড়িতে শিখিয়া মানুষ কী শিখিবে ও কতখানি শিখিবে সেটা পরের কথা, কিন্তু সে যে অন্তের কথা আপনি শুনিবে ও আপনার কথা অন্তকে শোনাইবে, এমনি করিয়া সে যে আপনার মধ্যে বৃহৎ মানুষকে ও বৃহৎ মানুষের মধ্যে আপনাকে পাইবে, তাহার চেতনার অধিকার যে চারি দিকে প্রশস্ত হইয়া যাইবে এইটেই গোড়াকার কথা । যুরোপে লোকসাধারণ আজ যে এক হইয়া উঠিবার শক্তি পাইয়াছে তাহার কারণ এ নয় যে তাহারা সকলেই পরম পণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছে। হয়তো আমাদের দেশাভিমানীরা প্রমাণ করিয়া দিতে পারেন যে পরাবিদ্যা বলিতে যাহা বুঝায় তাহ আমাদের দেশের সাধারণ লোকে তাহদের চেয়ে বেশি বোঝে, কিন্তু ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই যে যুরোপের সাধারণ লোকে লিখিতে পড়িতে শিখিয়া পরম্পরের কাছে পৌছিবার উপায় পাইয়াছে, হৃদয়ে হৃদয়ে গতিবিধির একটা মন্ত বাধা দূর হইয়া গেছে। এ কথা নিশ্চিত সত্য যে, যুরোপে লোকশিক্ষণ আপাতত অগভীর হইলেও তাহা যদি ব্যাপ্ত না হইত তবে আজ সেখানে লোকসাধারণ নামক যে সত্তা আপনার শক্তির গৌরবে জাগিয়া উঠিয়া আপন প্রাপ্য দাবি করিতেছে তাহাকে দেখা যাইত না । তাহা হইলে যে গরিব সে ক্ষণে ক্ষণে ধনীর প্রসাদ পাইয়া কৃতাৰ্থ হইত, যে ভৃত্য সে মনিবের পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পড়িয়া থাকিত এবং যে মজুর সে মহাজনের লাভের উচ্ছিষ্টকণামাত্র থাইয়া ক্ষুধাদগ্ধ পেটের একটা কোণমাত্র ভরাইত। লোকহিতৈষীরা বলিবেন, আমরা তো সেই কাজেই লাগিয়াছি— আমরা তো নাইট স্কুল খুলিয়াছি। কিন্তু ভিক্ষার দ্বারা কেহ কখনো সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারে