পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালাস্তর : ९*१. পরমতত্ব নয়। বিশ্বের তাল-মেলাবার বেলায় আপনাকে তার থামিয়ে দিতে হয়। সেই সংযমের সিংহদ্বারই হচ্ছে কল্যাণের সিংহদ্বার। এই কল্যাণের মূল্য আয়তন নিয়ে নয়, বহুলতা নিয়ে নয়। যে একে অন্তরে জেনেছে, সে ছিন্ন কস্থায় লজ্জা পায় না, সে রাজমুকুট ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়তে পারে। , শক্তিতত্ত্ব থেকে স্বযমাতত্ত্বে এসে পৌঁছিয়েই বুঝতে পারি, ভুল জায়গায় এতদিন এত নৈবেন্ত জুগিয়েছি। বলির পশুর রক্তে যে-শক্তি ফুলে উঠল সে কেবল ফেটে মরবার জন্তেই। তার পিছনে যতই সৈন্ত যতই কামান লাগাই না কেন, রণতরীর পরিধি যতই বৃদ্ধির দিকে নিয়ে চলি, লুঠের ভাগকে যতই বিপুল করে তুলতে থাকি, অন্ধের জোরে মিথ্যাকে সত্য করা যাবে না, শেষকালে ঐ অতিবড়ো অঙ্কেরই চাপে নিজের বস্তার নীচে নিজে গুড়িয়ে মরতে হবে । যাজ্ঞবল্ক্য যখন জিনিসপত্র বুঝিয়ে স্থঝিয়ে দিয়ে এই অঙ্ক-কষার রাজ্যে মৈত্রেয়ীকে প্রতিষ্ঠিত করে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখনই মৈত্রেয়ী বলেছিলেন, যেনাহং নামৃত স্তাম্ কিমহং তেন কুর্ষাম্। বহু, বহু, বহু, সব বহুকে জুড়ে জুড়েও, অন্ধের পর অন্ধ, যোগ করে করেও তবু তো অমৃতে গিয়ে পৌছনো যায় না। শব্দকে কেবলই অত্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে এবং চড়িয়ে দিয়ে ষে-জিনিসটা পাওয়া যায় সেটা হল হুংকার আর শবকে স্বর দিয়ে লয় দিয়ে সংযত সম্পূর্ণতা দান করলে যে-জিনিসটা পাওয়া যায় সেইটেই হল সংগীত ; ঐ হুংকারটা হল শক্তি, এর পরিমাণ পাওয়া যায়, আর সংগীতটা হল অমৃত, হাতে বহরে ওকে কোথাও মাপবার জো নেই। এই অমৃতের ক্ষেত্রে মানুষের অহংকারের স্রোত নিজের উলটো দিকে, উৎসর্জনের দিকে। মানুষ আপনার দিকে কেবলই সমস্তকে টানতে টানতে প্রকাগুতা লাভ করে, কিন্তু আপনাকে সমস্তর দিকে উৎসর্গ করতে করতে সে সামঞ্জস্য লাভ করে। এই সামঞ্জস্তেই শাস্তি। কোনো বাহব্যবস্থাকে বিস্তীর্ণতর করার দ্বারা শক্তিমানের সঙ্গে শক্তিমানকে জোড়া দিয়ে পুীভূত করার দ্বারা, কখনোই সেই শাস্তি পাওয়া যাবে না ষে-শাস্তি সত্যে প্রতিষ্ঠিত, যে-শাস্তি অলোভে, যে-শাস্তি সংযমে, ষে-শাস্তি ক্ষমায় । প্রশ্ন তুলেছিলুম— আমার সত্তার পরমমূল্যটি কোন সত্যের মধ্যে। শক্তিময়ের শক্তিতে, না, আনন্দময়ের আনন্দে ? শক্তিকেই যদি সেই সত্য বলে বরণ করি তা হলে বিরোধকেও চরম ও চিরন্তন বলে মানতেই হবে। রোপের অনেক আধুনিক লেখক সেই কথাই স্পর্ধাপূর্বক প্রচার করছেন। তারা বলছেন, শাস্তির ধর্ম, প্রেমের ধর্ম, দুর্বলের আত্মরক্ষা করবার কৃত্রিম দুর্গ ; বিশ্বের বিধান এই দুর্গকে খাতির করে না ; শেষ পর্যন্ত শক্তিরই জয় হয়—