পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালাস্তর לכיסא সেদিনকার শক্তির স্বপ্ন স্বল্পমাত্র, সে স্বপ্নের মূল ক্ষুধা ভয় পরিশ্রমের মধ্যে। শোনা গেছে ইতিহাসের গান অমিত্রাক্ষরে হয় না, এর চরণে-চরণে মিল । সেই পাঁচশো বছর পূর্বের এক চরণের সঙ্গে আজ পাচশো বছর পরের এক চরণের চমৎকার মিল শোনা যাচ্ছে না কি। যুরোপের শক্তিপূজক আজ বুক ফুলিয়ে বড়ো সমারোহেই শক্তির পুজো করছেন ; মদে তার দুই চক্ষু জবাফুলের মতো টক্‌টক করছে ; খাড় শাণিত ; বলির পশু যুপে বাধা । তারা কেউ কেউ বলছেন, আমরা যিশুকে মানি নে, আবার কেউ কেউ ভারতচন্দ্রের মতো গোজামিলন দিয়ে বলছেন, যিশুর সঙ্গে শক্তির সঙ্গে ভেদ করে দেওয়া ঠিক নয়, অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে দুজনকেই সমান মানবার মন্ত্র আছে। অর্থাৎ, একদল মদ খাচ্ছেন রাজাসনে বসে, আরেক দল পুলপিটে চড়ে। আর আমরাও বলছি, শিবকে মানব না। শিবকে মান কাপুরুষতা । আমরা চণ্ডীর মঙ্গল গাইতে বসেছি। কিন্তু সে মঙ্গলগান স্বপ্নলব্ধ । ক্ষুধা-ভয়-পরিশ্রমের স্বপ্ন। জয়ীর চণ্ডীপূজায় আর পরাজিতের চণ্ডীগানে এই তফাত । স্বপ্নেতেই যে আমাদের চণ্ডীগানের আদি এবং স্বপ্নেতেই যে তার অস্ত তার প্রমাণ কী। ঐ দেখে-না ব্যাধের দশা, তার স্ত্রী ফুল্লরার বারমান্ত একবার শোনো ; কিন্তু হল কী । হঠাৎ খামখেয়ালী শক্তি বিনা কারণে তাকে এমন-একটা আঙটি দিলেন যে, ঘরে আর টাকা ধরে না । কলিঙ্গরাজের সঙ্গে এই সামান্ত ব্যাধ যখন লড়াই করল, তখন খামক স্বয়ং হকুমান এসে তার পক্ষ নিয়ে কলিঙ্গের সৈন্তকে কিলিয়ে লাথিয়ে একাকার করে দিলে। একেই বলে শক্তির স্বপ্ন, ক্ষুধা এবং ভয়ের বরপুত্র। হঠাৎ একটা কিছু হবে। তাই সেই অতি-অদ্ভূত হঠাতের আশায় আমরা দলে দলে উচ্চৈঃস্বরে মা মা করে চণ্ডীগান করতে লেগে গেছি। সেই চণ্ডী স্তায় অন্যায় মানে না, সুবিধার খাতিরে সত্যমিথ্যায় সে ভেদ করে না, সে যেন-তেন প্রকারে ছোটোকে বড়ো, দরিদ্রকে ধনী, অশক্তকে শক্তিমান করে দেয়। তার জন্তে যোগ্য হবার দরকার নেই, অন্তরের দারিদ্র্য দূর করবার প্রয়োজন হবে না, যেখানে যা যেমনভাবে আছে আলস্তভরে সেখানে তাকে তেমনি ভাবেই রাখা চলবে । কেবল করজোড়ে তারস্বরে বলতে হবে— মা মা মা ! যখন মোগলপাঠানের বস্তা দেশের উপর ভেঙে পড়ল, তখন সংসারের যে-বাহরূপ মানুষ প্রবল করে দেখতে পেলে সেটা শক্তিরই রূপ। সেখানে ধর্মের হিসাব পাওয়া যায় না, সেখানে শিবের পরিচয় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। মানুষ যদি তখনো সমস্ত দুঃখ এবং পরাভবের মাঝখানে দাড়িয়ে বলতে পারে, আমি সব সদ্ধ করব তবুও কিছুতেই একে দেবতা বলে মানতে পারব না, তা হলেই মানুষের জিত হয় । চাদসদাগর