পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর ৪১৩ মানুষ বঁাচছে না। একমাত্র কামুন্দি তৈরি করবার বেলাতেই বিশ্বস্থদ্ধ লোকে মিলে নিয়ম মানার মতোই, একমাত্র সুতো তৈরির বেলাতেই তেত্রিশ কোটি লোকে মিলে বিশেষ আচার রক্ষা । তাতে স্বতে অনেক জমবে, কিন্তু যুগে যুগে যে অন্ধত জমে উঠে আমাদের দারিদ্র্যকে গডবন্দী করে রেখেছে তার গায়ে হাত পড়বে না। মহাত্মাজির সঙ্গে কোনো বিষয়ে আমার মতের বা কার্যপ্রণালীর ভিন্নতা আমার পক্ষে অত্যন্ত অরুচিকর। বড়ো করে দেখলে তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু তবু সব সময়ে মন মানে না । কেননা, র্যাকে প্রতি করি, ভক্তি করি, তার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার মতো আনন্দ আর কী হতে পারে। র্তার মহৎ চরিত্র আমার কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয় । ভারতের ভাগ্যবিধাতা তার হাত দিয়ে একটি দীপ্যমান দুর্জয় দিব্যশক্তি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই শক্তি ভারতবাসীকে অভিভূত না করুক, বলশালী করুক ; তাকে নিজের মন দিয়ে চিন্তা করতে, সংকল্প করতে, ত্যাগ করতে শিক্ষা দিক— এই আমার কামনা। যে কারণ ভিতরে থাকাতে রামমোহন রায়ের মতো অত বড়ো মনস্বীকেও মহাত্মা বামন বলতে কুষ্ঠিত হন নি— অথচ আমি সেই রামমোহনকে আধুনিক যুগের মহত্তম লোক বলেই জানি— সেই আভ্যন্তরিক মনঃপ্রকৃতিগত কারণই মহাত্মাজির কর্মবিধিতে এমন রূপ ধারণ করেছে যাকে আমার স্বধৰ্ম আপন বলে গ্রহণ করতে পারছে না । সেজন্তে আমার খেদ রয়ে গেল। কিন্তু, সাধনার বিচিত্র পথই বিধাতার অভিপ্রেত, নইলে প্রকৃতিভেদ জগতে কেন থাকবে । ব্যক্তিগত অনুরাগের টানে মহাত্মাজির কাছ থেকে চরকায় দীক্ষা নেবার প্রবল ইচ্ছা বারে বারে আমার মনে এসেছে। কিন্তু, আমার বুদ্ধিবিচারে চরকার যতটুকু মর্যাদা তার চেয়ে পাছে বেশি স্বীকার করা হয়, এই ভয়ে অনেক দ্বিধা করে নিরস্ত হয়েছি। মহাত্মাজি আমাকে ঠিক বুঝবেন জানি, এবং পূর্বেও বারবার আমার প্রতি যেমন ধৈর্য রক্ষা করেছেন আজও করবেন ; আচার্ষ রায়মশায়ও জনাদরনিরপেক্ষ মতস্বাতন্ত্র্যকে শ্রদ্ধা করেন, অতএব মাঝে মাঝে বস্তৃতাসভায় যদিচ মুখে তিনি আমাকে অকস্মাৎ তাড়না করে উঠবেন, তবু অস্তরে আমার প্রতি নিষ্করণ হবেন না। আর, যারা আমার দেশের লোক, যাদের চিত্তস্রোত বেয়ে উপকার আর অপকার উভয়েরই কত স্মৃতি অতলের মধ্যে তলিয়ে গেল, তারা আজ আমাকে যদি ক্ষমা না করেন কাল সমস্তই ভুলে যাবেন। আর যদিবা না ভোলেন, আমার কপালে তাদের হাতের লাঞ্ছনা যদি কোনোদিন নাও ঘোচে, তবে আজ যেমন আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথকে লাঞ্ছনার সঙ্গী পেয়েছি কালও তেমনি হয়তো এমন কোনো কোনো স্বদেশের অনাদৃত লোককে পাব যাদের দীপ্তি দ্বারা লোকনিন্দ নিন্দিত হয় । ভাদ্র ১৩৩২