পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি NYV9 Wb বালিকা যে রমেশের পরিণীতা স্ত্রী নহে। এ কথা রমেশ বুঝিল, কিন্তু সে যে কাহার স্ত্রী তাহা বাহির করা সহজ হইল না। রমেশ তাহাকে কৌশল করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বিবাহের সময় তুমি আমাকে যখন প্রথম দেখিলে, তখন তোমার কী মনে হইল ?” বালিকা কহিল, “আমি তো তোমাকে দেখি নাই, আমি চােখ নিচু করিয়া ছিলাম।” রমেশ । তুমি আমার নামও শুন নাই ? বালিকা | যেদিন শুনিলাম বিবাহ হইবে, তাহার পরের দিনই বিবাহ হইয়া গেল— তোমার নাম আমি শুনিই নাই। মামী আমাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করিয়া বাচিয়াছেন । রমেশ । আচ্ছা, তুমি যে লিখিতে-পড়িতে শিখিয়াছ, তোমার নিজের নাম বানান করিয়া লেখো দেখি । রমেশ তাহাকে একটু কাগজ, একটা পেনসিল দিল। সে বলিল, “তা বুঝি আমি আর পারি না ! আমার নাম বানান করা খুব সহজ ।”— বলিয়া বড়ো বড়ো অক্ষরে নিজের নাম লিখিল— শ্ৰীমতী কমলা দেবী । রমেশ । আচ্ছা, মামার নাম লেখো । কমলা লিখিল— শ্ৰীযুক্ত তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়। জিজ্ঞাসা করিল, “কোথাও ভুল হইয়াছে ?” রমেশ কহিল, “না | আচ্ছা, তোমাদের গ্রামের নাম লেখো দেখি ” সে লিখিল— ধোবাপুকুর । এইরূপে নানা উপায়ে অত্যন্ত সাবধানে রমেশ এই বালিকার যেটুকু জীবনবৃত্তান্ত আবিষ্কার করিল তাহাতে বড়ো-একটা সুবিধা হইল না। তাহার পরে রমেশ কর্তব্য সম্বন্ধে ভাবিতে বসিয়া গেল। খুব সম্ভব, ইহার স্বামী ডুবিয়া মরিয়াছে। যদি বা শ্বশুরবাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়, সেখানে পাঠাইলে তাহারা ইহাকে গ্ৰহণ করিবে কি না সন্দেহ । মামার বাড়ি পাঠাইতে গেলেও ইহার প্রতি ন্যায়ীচরণ করা হইবে না। এতকাল বধূভাবে অন্যের বাড়িতে বাস করার পর আজ যদি প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করা যায়, তবে সমাজে ইহার কী গতি হইবে, কোথায় ইহার স্থান হইবে ? স্বামী যদি বাচিয়াই থাকে, তবে সে কি ইহাকে গ্ৰহণ করিতে ইচ্ছা বা সাহস করিবে ? এখন এই মেয়েটিকে যেখানেই ফেলা হইবে সেখানেই সে অতল সমুদ্রের মধ্যে পড়িবে | ইহাকে স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনোরূপেই রমেশ নিজের কাছে রাখিতে পারে না, অন্যত্রও কোথাও ইহাকে রাখিবার স্থান নাই । কিন্তু তাই বলিয়া ইহাকে নিজের স্ত্রী বলিয়া গ্ৰহণ করাও চলে না । রমেশ এই বালিকাটিকে ভবিষ্যতের পটে নানা বর্ণের স্নেহসিক্ত তুলি দ্বারা ফলাইয়া যে গৃহলক্ষ্মীর মূর্তি রমেশ আর তাহার গ্রামে থাকিতে পারিল না । কলিকাতায় লোকের ভিড়ের মধ্যে আচ্ছন্ন থাকিয়া একটা কিছু উপায় খুজিয়া পাওয়া যাইবে, এই কথা মনে করিয়া রমেশ কমলাকে লইয়া কলিকাতায় আসিল এবং পূর্বে যেখানে ছিল, সেখান হইতে দূরে নূতন এক বাসা ভাড়া করিল। কলিকাতা দেখিবার জন্য কমলার আগ্রহের সীমা ছিল না । প্রথম দিন বাসার মধ্যে প্ৰবেশ করিয়া সে জানলায় গিয়া বসিল— সেখান হইতে জনস্রোতের অবিশ্রাম প্রবাহে তাহার মনকে নূতন নূতন কৌতুহলে ব্যাপৃত করিয়া রাখিল । ঘরে একজন ঝি ছিল, কলিকতা তাহার পক্ষে অত্যন্ত পুরাতন । সে বালিকার বিস্ময়কে নিরর্থক মূঢ়তা জ্ঞান করিয়া বিরক্ত হইয়া বলিতে লাগিল, “ঠাগা, হা করিয়া কী দেখিতেছি ? বেলা যে অনেক হইল, চান করিবে না ?” ঝি দিনের বেলায় কাজ করিয়া রাত্রে বাড়ি চলিয়া যাইবে । রাত্রে থাকিবে, এমন লোক পাওয়া গেল না ; রমেশ ভাবিতে লাগিল, “কমলাকে এখন তো এক শয্যায় আর রাখিতে পারি না- অপরিচিত জায়গায় সে বালিকা একলাই বা কী করিয়া রাত কাটাইবে... ?