পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

こ〉や রবীন্দ্র-রচনাবলী হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “তবু ভালো, আমাদের খবর রাখেন ।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “তুমি এখন বাসা কোথায় করিয়াছ ?” রমেশ কহিল, “দরজিপাড়ায় ।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “কেন, কলুটােলায় তোমার সাবেক বাসা তো মন্দ ছিল না।” উত্তরের অপেক্ষায় হেমনলিনী বিশেষ কৌতুহলের সহিত রমেশের দিকে চাহিল। সেই দৃষ্টি রমেশকে আঘাত করিল— সে তৎক্ষণাৎ বলিয়া ফেলিল, “হা, সেই বাসাতেই ফিরিবস্থির করিয়াছি।” তাহার এই বাসা-বদল করার অপরাধ যে হেমনলিনী গ্রহণ করিয়াছে, তাহা রমেশ বেশ বুঝিল— সাফাই করিবার কোনো উপায় নাই জানিয়া সে মনে মনে পীড়িত হইতে লাগিল । অন্য পক্ষ হইতে আর কোনো প্রশ্ন উঠিল না । হেমনলিনী গাড়ির বাহিরে পথের দিকে চাহিয়া রহিল। রমেশ আর থাকিতে না পারিয়া অকারণে আপনি কহিয়া উঠিল, “আমার একটি আত্মীয় হেদুয়ার কাছে থাকেন, রমেশ নিতান্ত মিথ্যা বলিল না, কিন্তু কথাটা কেমন অসংগত শুনাইল । মাঝে মাঝে আত্মীয়ের খবর লাইবার পক্ষে কলুটােলা হেদুয়া হইতে এতই কি দূর ? হেমনলিনীর দুই চক্ষু গাড়ির বাহিরে পথের দিকেই নিবিষ্ট হইয়া রহিল। হতভাগ্য রমেশ ইহার পরে কী বলিবে, কিছুই ভাবিয়া পাইল না । একবার কেবল জিজ্ঞাসা করিল, “যোগেনের খবর কী ?” অন্নদাবাবু কহিলেন, “সে আইন-পরীক্ষায় ফেল করিয়া পশ্চিমে হাওয়া খাইতে গেছে ।” গাড়ি যথাস্থানে পৌঁছিলে পর পরিচিত ঘর ও গৃহসজ্জাগুলি রমেশের উপর মন্ত্ৰজাল বিস্তার করিয়া দিল । রমেশের বুকের মধ্য হইতে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস উত্থিত হইল । রমেশ কিছু না বলিয়াই চা খাইতে লাগিল। অন্নদাবাবু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এবার তো তুমি অনেকদিন বাড়িতে ছিলে, কাজ ছিল বুঝি ?” রমেশ কহিল, “বাবার মৃত্যু হইয়াছে।” অন্নদা । আঁ্যা, বল কী ! সে কী কথা ! কেমন করিয়া হইল ? রমেশ । তিনি পদ্মা বাহিয়া নীেকা করিয়া বাড়ি আসিতেছিলেন, হঠাৎ ঝড়ে নীেকা ডুবিয়া তাহার भू. २श ! একটা প্রবল হাওয়া উঠিলে যেমন অকস্মাৎ ঘন মেঘ কাটিয়া আকাশ পরিষ্কার হইয়া যায়, তেমনি এই শোকের সংবাদে রমেশ ও হেমনলিনীর মাঝখানকার গ্লানি মুহুর্তের মধ্যে কাটিয়া গেল । হেম অনুতাপসহকারে মনে মনে কহিল, ‘রমেশবাবুকে ভুল বুঝিয়েছিলাম।— তিনি পিতৃবিয়োগের শোকে এবং গোলমালে উদভ্ৰান্ত হইয়া ছিলেন । এখনো হয়তো তাঁহাই লইয়া উন্মনা হইয়া আছেন । উহার সাংসাবিক কী সংকট ঘটিয়াছে, উহার মনের মধ্যে কী ভার চাপিয়াছে, তাহা কিছুই না জানিয়াই আমরা উহাকে দোষী করিতেছিলাম ।” হেমনলিনী এই পিতৃহীনকে বেশি করিয়া যত্ন করিতে লাগিল । রমেশের আহারে অভিরুচি ছিল না, হেমনলিনী তাহাকে বিশেষ পীড়াপীড়ি করিয়া খাওয়াইল । কহিল, “আপনি বড়ো রোগ হইয়া গেছেন, শরীরের অযত্ন করবেন না ।” অন্নদাবাবুকে কহিল, “বাবা, রমেশবাবু আজ রাত্রেও এইখানেই খাইয়া शन्म-•ा |" অন্নদাবাবু কহিলেন, “ বেশ তো ।” এমন সময় অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত । অন্নদাবাবুর চায়ের টেবিলে কিছুকাল অক্ষয় একাধিপত্য করিয়া আসিয়াছে । আজ সহসা রমেশকে দেখিয়া সে থমকিয়া গেল | আত্মসংবরণ করিয়া হাসিয়া কহিল, “এ কী ! এ যে রমেশবাবু! আমি বলি, আমাদের বুঝি একেবারেই ভুলিয়া গেলেন ।” রমেশ কোনো উত্তর না দিয়া একটুখানি হাসিল । অক্ষয় কহিল, “আপনার বাবা আপনাকে যে-রকম তাড়াতাড়ি গ্রেফতার করিয়া লইয়া গেলেন, আমি ভাবিলাম, তিনি এবার আপনার বিবাহ না দিয়া কিছুতেই ছাড়িবেন না— ফাডা কাটাইয়া আসিয়াছেন তো ?”