পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি RAC) অক্ষয়বাবু, আপনি অন্নদাবাবুর বন্ধু হইতে পারেন, কিন্তু আমার সহিত আপনার তেমন বেশি ঘনিষ্ঠতা হয় নাই। দয়া করিয়া আপনি এসব প্রসঙ্গ বন্ধ করুন।” অক্ষয় । আমি বন্ধ করিলেই যদি সব কথা বন্ধ থাকে এবং আপনি এখন যেমন ফলাফলের প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া বেশ আরামে দিন কটাইতেছেন, এমনি বরাবর কাঁটাইতে পারিতেন, তাহা হইলে কোনো কথা ছিল না । কিন্তু সমােজ আপনাদের মতো নিশ্চিম্ভপ্রকৃতি লোকের পক্ষে সুখের স্থান নহে। যদিও আপনারা অত্যন্ত উঁচুদরের লোক, পৃথিবীর কথা বড়ো বেশি ভাবেন না, তবু চেষ্টা করিলে হয়তো এটুকুও বুঝিতে পরিবেন যে, ভদ্রলোকের কন্যার সহিত আপনি যেরূপ ব্যবহার করিতেছেন, একাপ করিয়া আপনি বাহিরের লোকের জবাবদিহি হইতে নিজেকে বাচাইতে পারেন না- এবং যাহাদিগকে আপনি শ্রদ্ধা করেন তাহাদিগকে লোকসমাজে অশ্রদ্ধাভাজন করিবার ইহাই উপায় । রমেশ । আপনার উপদেশ আমি কৃতজ্ঞতার সহিত গ্ৰহণ করিলাম। আমার যাহা কৰ্তব্য তাহা আমি শীঘ্রই স্থির কবিব এবং পালন করিব, এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত হইবেন- এ সম্বন্ধে আর অধিক আলোচনা করিবার প্রয়োজন নাই । অক্ষয় | আমাকে বীচাইলেন রমেশবাবু। এত দীর্ঘকাল পরে আপনি যে কর্তব্য স্থির করিবেন এবং পালন করিবেন বলিতেছেন, ইহাতেই আমি নিশ্চিন্ত হইলাম— আপনার সঙ্গে আলোচনা করিবার শখ আমার নাই ; আঁপনার সংগীতচর্চায় বাধা দিয়া অপরাধী হইয়াছি— মাপ করিবেন। আপনি পুনর্বার শুরু করুন, আমি বিদায় হইলাম । এই বলিয়া অক্ষয় দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গৈল । ইহার পরে অত্যন্ত বেসুরা সংগীতচর্চাও আর চলে না। রমেশ মাথার নীচে দুই হাত রাখিয়া বিছানার উপরে চিত হইয়া শুইয়া পড়িল । অনেকক্ষণ। এইভাবে গেল। হঠাৎ ঘড়িতে টং টং করিয়া পাঁচটা বাজিল শুনিয়াই সে দ্রুত উঠিয়া পড়িল ৷ কী কর্তব্য স্থির করিল। তাহা অন্তৰ্যামীই জানেনকিন্তু আশু প্রতিবেশীর ঘরে গিয়া যে পেয়ালা-দুয়েক চা খাওয়া কর্তব্য, সে সম্বন্ধে তাহার মনে দ্বিধামাত্র রহিল না । হেমনলিনী চকিত হইয়া কহিল, “রমেশবাবু, আপনার কি অসুখ করিয়াছে ?” রমেশ কহিল, “বিশেষ কিছু না ।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “আর কিছুই নয়, হজমের গোল হইয়াছে- পিত্তাধিক্য। আমি যে পিল ব্যবহার করিয়া থাকি তাহার একটা খাইয়া দেখো দেখি-” হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “বাবা, ঐ পিল খাওয়াও নাই, তোমার এমন আলাপী কেহ দেখি না।-- কিন্তু তাহদের এমন কী উপকার হইয়াছে ?” অন্নদা ! অনিষ্ট তো হয় নাই ! আমি যে নিজে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়ছি- এ পর্যন্ত যতরকম পিল খাইয়াছি, এইটেই সব চেয়ে উপকারী । হেমনলিনী । বাবা, যখন তুমি একটা নূতন পিল খাইতে আরম্ভ কর, তখনই কিছুদিন তাহার অশেষ গুণ দেখিতে পাও— অন্নদা ! তোমরা কিছুই বিশ্বাস কর না— আচ্ছা, অক্ষয়কে জিজ্ঞাসা করিয়াে দেখি, আমার চিকিৎসায় সে উপকার পাইয়াছে কি না | সেই প্রমাণিক সাক্ষীকে তলবের ভয়ে হেমনলিনীকে নিরুত্তর হইতে হইল। কিন্তু সাক্ষী আপনি আসিয়া হাজির হইল। আসিয়াই অন্নদাবাবুকে কহিল, “অন্নদাবাবু, আপনার সেই পিল আমাকে আর-একটি দিতে হইবে । বড়ো উপকার হইয়াছে । আজ শরীর এমনি হালকা বোধ হইতেছে ।” অন্নদাবাবু সগর্বে ঠাঁহার কন্যার মুখের দিকে তাকাইলেন।