পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SO8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বালিকার পাশে নীরবে দাড়াইয়া জীবনকে ও জগৎকে এক অপরিসীম-আনন্দময় রহস্যের মাঝখানে ভাসমান দেখিল- এ কী বিস্ময় ! হৃদয়ের ভিতরে আজ এ কী বিস্ময়, হৃদয়ের বাহিরে আজ এ কী বিস্ময় ! অনেক রাত্রি পর্যন্ত রমেশ ছাদে বেড়াইল। ধীরে ধীরে কখন এক সময়ে খণ্ড-চাঁদ সম্মুখের বাড়ির আড়ালে নামিয়া গেল। পৃথিবীতলে রাত্রির কালিমা ঘনীভূত হইল— আকাশ তখনো বিদায়েমুখ আলোকের আলিঙ্গনে পাণ্ডুবর্ণ। রমেশের ক্লান্ত শরীর শীতে শিহরিয়া উঠিল। হঠাৎ একটা আশঙ্কা থাকিয়া থাকিয়া তাহার হৃৎপিণ্ডকে চাপিয়া ধরিতে লাগিল। মনে পড়িয়া গেল জীবনের রণক্ষেত্রে কাল আবার সংগ্রাম করিতে বাহির হইতে হইবে। ঐ আকাশে যদিও চিন্তার রেখা নাই, জ্যোৎস্নার মধ্যে চেষ্টার চাঞ্চল্য নাই, রাত্রি যদিও নিস্তব্ধ শান্ত, বিশ্বপ্রকৃতি ঐ অগণ্য নক্ষত্ৰলোকের চিরকর্মের মধ্যে চিরবিশ্রামে বিলীন— তবু মানুষের আনাগোনা যোঝাযুঝির অন্ত নাই, সুখে-দুঃখে বাধায়-বিয়ে সমস্ত জনসমাজ তরঙ্গিত । এক দিকে অনন্তের ঐ নিত্য শান্তি, আর-এক দিকে সংসারের এই নিত্য সংগ্ৰাম— দুই একই কালে একসঙ্গে কেমন করিয়া থাকিতে পারে, দুশ্চিন্তার মধ্যেও রমেশের মনে এই প্রশ্নের উদয় হইল। কিছুক্ষণ পূর্বে রমেশ বিশ্বলোকের অন্তঃপুরের মধ্যে প্রেমের যে একটি শাশ্বত সম্পূৰ্ণ শান্ত মূর্তি দেখিয়াছিল, সেই প্রেমকেই ক্ষণকাল পরে সংসারের সংঘর্ষে, জীবনের জটিলতায়, পদে-পদে ক্ষুব্ধ ক্ষুন্ন দেখিতে লাগিল। ইহার মধ্যে কোনটা সত্য, কোনটা মায়া ? ya পরদিন সকালের গাড়িতে যোগেন্দ্ৰ পশ্চিম হইতে ফিরিয়া আসিল । আজ শনিবার, কাল রবিবারে হেমনলিনীর বিবাহের কথা । কিন্তু যোগেন্দ্র তাহদের বাসার দ্বারের কাছে আসিয়া উৎসবের স্বাদগন্ধ কিছুই পাইল না। যোগেন্দ্ৰ মনে করিয়া আসিতেছিল এতক্ষণে তাঁহাদের বাসার বারান্দার উপর দেবদারুপাতার মালা ঝোলানো শুরু হইয়াছে— কাছে আসিয়া দেখিল, শ্ৰীহীন মালিন্যে পাশের বাড়ির সঙ্গে তাহদের বাড়ির কোনো প্ৰভেদ নাই । ভয় হইল পাছে কাহারও অসুখ-বিসুখ করিয়া থাকে । বাড়িতে প্রবেশ করিয়া দেখিল চায়ের টেবিলে তাহার জন্য আহারাদি প্রস্তুত রহিয়াছে এবং অন্নদাবাবু অর্ধভুক্ত চায়ের পেয়ালা সম্মুখে রাখিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন । যোগেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “হেম কেমন আছে ?” অন্নদা । ভালো । যোগেন্দ্র । বিবাহের কী হইল ? অন্নদা। কাল রবিবারের পরের রবিবারে হইবে । 6शgीी | 6न्म ? অন্নদা। কেন, তাহা তোমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করে । রমেশ আমাদের কেবল এইটুকু জানাইয়াছে যে, তাহার বিশেষ প্রয়োজন আছে, এ রবিবারে বিবাহ বন্ধ রাখিতে হইবে । যোগেন্দ্ৰ তাহার অক্ষম বাপের উপরে মনে মনে বিরক্ত হইয়া কহিল, “বাবা, আমি না থাকিলে তোমাদের নানান গলদ ঘটে । রমেশের আবার প্রয়োজন কিসের ? সে স্বাধীন । তাহার আত্মীয় বলিতে কেহ নাই বলিলেই হয়। যদি তাহার বৈষয়িক বিশেষ কোনো গোলযোগ ঘটিয়া থাকে, সে কথা খুলিয়া বলিবার কোনো বাধা দেখি না। রমেশকে তুমি এত সহজে ছাড়িয়া দিলে কেন ?" অন্নদা। আচ্ছা, বেশ তো, সে তো এখনো পালায় নাই- তুমিই তাহাকে প্রশ্ন করিয়া দেখো-না । যোগেন্দ্ৰ শুনিয়া তৎক্ষণাৎ এক পেয়ালা গরম চা তাড়াতাড়ি নিঃশেষ করিয়া বাহির হইয়া গেল । অন্নদাবাবু কহিলেন, “আহা যোগেন, এত তাড়াতাড়ি কিসের ? তোমার যে খাওয়া হইল না।”