পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি S80 A হেমনলিনী আবার নীরবে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, “না।” তাহাদের সকলের চেয়ে রমেশের উপরেই এমন অসন্দিগ্ধ বিশ্বাসে যোগেন্দ্র রাগ করিল। সাবধানে ভূমিকা করিয়া কথা পাড়া আর চলিল না। যোগেন্দ্র কঠিনভাবে বলিতে লাগিল, “তোমার তো মনে আছে, রমেশ মাস-ছায়েক আগে তাহার বাপের সঙ্গে দেশে চলিয়া গিয়াছিল। তাহার পরে অনেক দিন তাহার কোনো চিঠিপত্র না পাইয়া আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিলাম। ইহাও তুমি জান যে, যে রমেশ দুই বেলা আমাদের এখানে আসিত, যে বরাবর আমাদের পাশের বাড়িতে বাসা লইয়া ছিল, সে কলিকাতায় আসিয়া আমাদের সঙ্গে একবারও দেখাও করিল না, অন্য বাসায় গিয়া গা-ঢাকা দিয়া রহিল— ইহা সত্ত্বেও তোমরা সকলে পূর্বের মতো বিশ্বাসেই তাহকে ঘরে ডাকিয়া আনিলে ! আমি থাকিলে এমন কি কখনো ঘটিতে পারিত ?" হেমনলিনী চুপ করিয়া রহিল ; যোগেন্দ্র। রমেশের এইরূপ ব্যবহারের কোনো অর্থ তোমরা খুজিয়া পাইয়াছ ? এ সম্বন্ধে একটা প্রশ্নও কি তোমাদের মনে উদয় হয় নাই ? রমেশের পরে এত গভীর বিশ্বাস ! হেমনলিনী নিরুত্তর । যোগেন্দ্র । আচ্ছা, বেশ কথা- তোমরা সরলস্বভাব, কাহাকেও সন্দেহ কর না- আশা করি, আমার উপরেও তোমার কতকটা বিশ্বাস আছে। আমি নিজে ইস্কুলে গিয়া খবর লইয়াছি, রমেশ তাহার স্ত্রী কমলাকে সেখানে বোর্ডার রাখিয়া পড়াইতেছিল। ছুটির সময়েও তাহাকে সেখানে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল। হঠাৎ দুই-তিন দিন হইল, ইস্কুলের কত্রীর নিকট হইতে রমেশ চিঠি পাইয়াছে যে, ছুটির সময়ে কমলাকে ইস্কুলে রাখা হইবে না। আজ তাঁহাদের ছুটি ফুরাইয়াছে— কমলাকে ইস্কুলের গাড়ি দরজিপাড়ায় তাহাদের সাবেক বাসায় পৌছাইয়া দিয়াছে। সেই বাসায় আমি নিজে গিয়াছি । গিয়া দেখিলাম, কমলা বঁটিতে আপেলের খোসা ছাড়াইয়া কাটিয়া দিতেছে, রমেশ তাহার সুমুখে মাটিতে বসিয়া এক-এক টুকরা লইয়া মুখে পুরিতেছে । রমেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম, 'ব্যাপারখানা কী ? রমেশ বলিল, সে এখন আমাদের কাছে কিছুই বলিবে না। যদি রমেশ একটা কথাও বলিত যে, কমলা তাহার স্ত্রী নয়, তা হলেও নাহয় সেই কথাটুকুর উপর নির্ভর করিয়া কোনোমতে সন্দেহকে শান্ত করিয়া রাখিবার চেষ্টা করা যাইত । কিন্তু সে হা-না কিছুই বলিতে চায় না । এখন, ইহার পরেও কি রমেশের উপর বিশ্বাস রাখিতে চাও ? প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় যোগেন্দ্ৰ হেমনলিনীর মুখের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল তাহার মুখ অস্বাভাবিক বিবৰ্ণ হইয়া গেছে, এবং তাহার যতটা জোর আছে দুই হাতে চৌকির হাত চাপিয়া ধরিবার সুন্টুড়ে ঘুঙ্কাল পরেই সমূহের দিকে ঝুঁকিয় পড়িয়া দুৰ্ছত ইয়া টােক ইহঁতে সে নীচে ঠয়া গেল । অন্নদাবাবু ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। তিনি ভুলুষ্ঠিত হেমনলিনীর মাথা দুই হাতে বুকের কাছে তুলিয়া লইয়া কহিলেন, “মা, কী হইল মা ! ওদের কথা তুমি কিছুই বিশ্বাস করিয়ো না- সব মিথ্যা।” যোগেন্দ্র তাহার পিতাকে সরাইয়া তাড়াতাড়ি হেমনলিনীকে একটা সোফার উপর তুলিল ; নিকটে কুঁজায় জল ছিল, সেই জল লইয়া তাহার মুখে-চোখে বারংবার ছিটাইয়া দিল, এবং অক্ষয় একখানা হাতপাখা লইয়া তাহাকে বেগে বাতাস করিতে লাগিল । হেমনলিনী অনতিকাল পরে চোখ খুলিয়াই চমকিয়া উঠিল ; অন্নদাবাবুর দিকে চাহিয়া চীৎকার করিয়া বলিল, “বাবা, বাবা, অক্ষয়বাবুকে এখন হইতে সরিয়া যাইতে বলে ।” অক্ষয় পাখা রাখিয়া ঘরের বাহিরে দরজার আড়ালে গিয়া দাড়াইল । অন্নদাবাবু সোফার উপরে হেমনলিনীর পাশে বসিয়া তাহার মুখে-গায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন, এবং গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কেবল একবার বলিলেন, “মা !” দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল ; তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিল ; পিতার জানুর উপর বুক চাপিয়া ধরিয়া তাহার অসহ্য রোদনের বেগ সংবরণ করিতে