পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি S8ፄ NS রাত্রি নয়টার সময় রমেশ কমলাকে লইয়া শেয়ালদহ-স্টেশনে যাত্রা করিল। যাইবার সময় একটু ঘুরপথ দিয় গেল। গাড়োয়ানকে অনাবশ্যক গােটাকতক গলি ঘুরাইয়া লইল। কলুটােলায় একটা বাড়ির কাছে আসিয়া,আগ্রহসহকারে মুখ বাড়াইয়া দেখিল । পরিচিত বাড়ির তো কোনো পরিবর্তন হয় ਸ | রমেশ এমন একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল যে, নিদ্রাবিষ্ট কমলা চকিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কী হইয়াছে ?” রমেশ উত্তর করিল, “কিছুই না।” আর কিছুই বলিল না ; গাড়ির অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া বহিল। দেখিতে দেখিতে গাড়ির কোণে মাথা রাখিয়া কমলা আবার ঘুমাইয়া পড়িল। ক্ষণকালের জন্য কমলার অস্তিত্বকে রমেশের যেন অসহ্য বোধ হইল । গাড়ি যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছিল। একটি সেকেণ্ড-ক্লাস গাড়ি পূর্ব হইতেই রিজার্ভ করা ছিল ; রমেশ ও কমলা তাহাতে উঠিল । এক দিকের বেঞ্চিতে কমলার জন্য বিছানা পাতিয়া গাড়ির বাতির হইয়া গেছে, এইখানে তুমি ঘুমাও।” কমলা কহিল, “গাড়ি ছাড়িলে আমি ঘুমাইব, ততক্ষণ আমি এই জানালার ধারে বসিয়া একটু দেখিব ?” রমেশ রাজি হইল। কমলা মাথায় কাপড় টানিয়া প্লাটফর্মের দিকের আসনপ্রান্তে বসিয়া লোকজনের আনাগোনা দেখিতে লাগিল । রমেশ মাঝের আসনে বসিয়া অন্যমনস্কভাবে চাহিয়া রহিল । গাড়ি যখন সবে ছাড়িয়াছে এমন সময় রমেশ চমকিয়া উঠিল— হঠাৎ মনে হইল, তাহার একজন চেনা লোক গাড়ির অভিমুখে ছুটিয়াছে। পরীক্ষণেই কমলা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। রমেশ জানলা হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিল— রেলওয়ে-কর্মচারীর বাধা কাটাইয়া একজন লোক কোনোক্রমে চলন্ত গাড়িতে উঠিয়াছে এবং টানাটানিতে তাহার চাদর কর্মচারীর হাতেই রহিয়া গেছে। চাদর লইবার জন্য সে ব্যক্তি যখন জানলা হইতে ঝুঁকিয়া পড়িয়া হাত বাড়াইল তখন রমেশ স্পষ্ট চিনিতে পারিল, সে আর কেহ নয়, অক্ষয় । এই চাদর-কাঁড়াকড়ির দৃশ্যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কমলার হাসি থামিতে চাহিল না। রমেশ কহিল, “সাড়ে দশটা বাজিয়া গেছে, গাড়ি ছাড়িয়ছে, এইবার তুমি ঘুমাও।” বালিকা বিছানায় শুইয়া যতক্ষণ না ঘুম আসিল, মাঝে মাঝে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। কিন্তু এই ব্যাপারে রমেশের বিশেষ কৌতুকবােধ হইল না। রমেশ জানিত, কোনো পল্লীগ্রামের সহিত অক্ষয়ের কোনাে সম্বন্ধ ছিল না ; সে পুরুষানুক্রমে কলিকাতাবাসী ; আজ রাত্রে এমন উর্ধ্বশ্বাসে সে কলিকাতা ছাড়িয়া কোথায় যাইতেছে ? রমেশ নিশ্চয় বুঝিল, অক্ষয় তাহারই অনুসরণে চলিয়াছে। অক্ষয় যদি তাহাদের গ্রামে গিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করে এবং সেখানে রমেশের স্বপক্ষবিপক্ষমণ্ডলীর মধ্যে এই কথা লইয়া একটা ঘাটাঘাটি হইতে থাকে, তবে সমস্ত ব্যাপারটা কিরূপ জঘন্য হইয়া উঠিবে, তাহাই কল্পনা করিয়া রমেশের হৃদয় অশান্ত হইয়া উঠিল । তাহাদের পাড়ায় কে কী বলিবে, কিরূপ ঘোট চলিবে, তাহা রমেশ যেন প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে লাগিল। কলিকাতার মতো শহরে সকল অবস্থাতেই অন্তরাল খুজিয়া পাওয়া যায়, কিন্তু ক্ষুদ্র পল্লীর গভীরতা কম বলিয়াই অল্প আঘাতেই তাহার আন্দোলনের ঢেউ উত্তাল হইয়া উঠে । সেই কথা যতই চিন্তা করিতে লাগিল রমেশের মন ততই সংকুচিত হইতে লাগিল । বারাকপুরে গান গাড়ি থামিল রমেশ মুখ বাড়াইয়া দেখিতে লাগিল, অক্ষয় নামিল না। নৈহাটিতে অনেক লোক উঠানামা করিতে লাগিল, তাহার মধ্যে অক্ষয়কে দেখা গেল না। একবার বৃথা আশায় বণ্ডলা স্টেশনেও রমেশ ব্যগ্র হইয়া মুখ বাড়াইল— অবরোহীদের মধ্যে অক্ষয়ের চিহ্ন নাই। তাহার