পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SG8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আবার সেই একই রকম ঠাট্ট ! কমলার কপোলে এবং কর্ণমূলে সন্ধ্যার আভার উপরে আগে একটুখানি রক্তিম আভা যোগ দিল ; সে মাথা বঁকাইয়া কহিল, “তুমি কী যে বল তাহার ঠিক নাই শোনো, তোমার খাবার তৈরি, একটু সকাল-সকাল খাইয়া লও। আজ ও বেলায় ভালো করিয়া খাওয়া হয় নাই ।” নদীর বাতাসে রমেশের ক্ষুধাবােধ হইতেছিল। আয়োজনের অভাবে পাছে কমলা ব্যস্ত হইয়া পড়ে সেইজন্য কিছুই বলে নাই ; এমন সময়ে অযাচিত আহারের সংবাদে তাহার মনে যে একটা সুখেই আন্দোলন তুলিল তাহার মধ্যে একটু বৈচিত্র্য ছিল। কেবল ক্ষুধানিবৃত্তির আসন্ন সম্ভাবনার সুখ নহে । কিন্তু সে যখন জানিতেছে না। তখনো যে তাহার জন্য একটি চিন্তা জাগ্ৰত আছে, একটি চেষ্টা ব্যাপুত্ৰ রহিয়াছে, তাহার সম্বন্ধে একটি কল্যাণের বিধান স্বত্তই কাজ করিয়া চলিয়াছে, ইহার গীেয়ব সে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব না করিয়া থাকিতে পারিল না । কিন্তু ইহা তাহার প্রাপ্য নহে, এতবড়ো জিনিসটা কেবল ভ্ৰমের উপরেই প্রতিষ্ঠিত এই চিন্তার নিষ্ঠুর আঘাতও সে এড়াইতে পারিল না— সে শিরনত করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কমলা তাহার মুখের ভাব দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, “তোমার বুঝি খাইতে ইচ্ছা নাই ? ক্ষুধা পায় নাই ? আমি কি তোমাকে জোর করিয়া খাইতে বলিতেছি ?” পেটের মধ্যেই জোর করিতেছে। এখন তো খুব চাবি ঠক ঠক করিয়া ডাকিয়া আনিলে, শেষকালে পরিবেশনের সময় যেন দৰ্পহারী মধুসূদন দেখা না দেন ।” এই বলিয়া রমেশ চারিদিকে চাহিয়া কহিল, “কই, খাদ্যদ্রব্য তো কিছু দেখি না। খুব ক্ষুধার জোর থাকিলেও এই আসবাবগুলা আমার হজম হইবে না ; ছেলেবেলা হইতে আমার অন্যরকম অভ্যাস ।" কমলা খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসির বেগ থামিলে কহিল, “এখন বুঝি আর সবুর সহিতেছে না ? যখন আকাশের দিকে তাকাইয়া ছিলে তখন বুঝি ক্ষুধাতৃষ্ণা ছিল না ? আর যেমন আমি ডাকিলাম অমনি মনে পড়িয়া গেল, ভারি ক্ষুধা পাইয়াছে। আচ্ছা, তুমি এক মিনিট বোসো, আমি স্কুল, কিন্তু দেরি হলে এই কলপ কষ্ট দেখতে পারেন—তখন আমার দেন शी भी ॥' রসিকতার এই পুনরুক্তিতে কমলার কম আমোদ বোধ হইল না। তাহার আবার ভারি হাসি পাইল । সরল হার্স্যোচ্ছাসে ঘরকে সুধাময় করিয়া দিয়া কমলা দ্রুতপদে খাবার আনিতে গেল ! রমেশের কাষ্ঠপ্ৰফুল্পতার ছদ্মদীপ্তি মুহুর্তের মধ্যে কালিমায় ব্যাপ্ত হইল। উপরে-শালপাতা-ঢাকা একটা চাঙারি লইয়া অনতিকাল পরেই কমলা কামরায় প্রবেশ করিল। বিছানার উপরে চাঙারি রাখিয়া আঁচল দিয়া ঘরের মেঝে মুছিতে লাগিল । রমেশ বাস্ত হইয়া কহিল, “ও কী করিতেছি ?” কমলা কহিল, “আমি তো এখনই কাপড় ছাড়িয়া ফেলিব।” এই বলিয়া শালপাতা তুলিয়া পাতিল ও তাহার উপরে লুচি ও তরকারি নিপুণ হস্তে সাজাইয়া দিল । রমেশ কহিল, “কী আশ্চর্য! লুচির জোগাড় করিলে কী করিয়া ?” কমলা সহজে রহস্য ফাস না করিয়া অত্যন্ত নিগৃঢ়ভােব ধারণ করিয়া কহিল, “কেমন করিয়া বলে। দেখি ।” রমেশ কঠিন চিন্তার ভান করিয়া কহিল, “নিশ্চয়ই খালাসিদের জলখাবার হইতে ভাগ বসাইয়াছ ।” কমলা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া কহিল, “ককখনো না | রাম বলে !” রমেশ খাইতে খাইতে লুচির আদিকারণ সম্বন্ধে যত রাজ্যের অসম্ভব কল্পনা দ্বারা কমলাকে রাগাইয়া তুলিল। যখন বলিল আরব-উপন্যাসের প্রদীপাওয়ালা আলােদীন বেলুচিস্থান হইতে গরম-গরম