পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NG? V2 রবীন্দ্র-রচনাবলী QC তীরের বনরাজি অবিচ্ছিন্ন মসীলেখায় সন্ধ্যাবধুর সোনার অঞ্চলে কালো পাড় টানিয়া দিল গ্রামান্তরের বিলের মধ্যে সমস্ত দিন চরিয়া বন্যহংসের দল আকাশের স্নানায়মান সূর্যস্তদীপ্তির মধ্য দিয়া ও পারের তরুশূন্য বালুচরে নিভৃত জলাশয়গুলিতে রাত্রিযাপনের জন্য চলিয়াছে। কাকেদের বাসা আসিবার কলরব থামিয়া গেছে। নদীতে তখন নীেকা ছিল না ; একটিমাত্র বড়ো ডিঙি গাঢ় সোনালি-সবুজ নিস্তরঙ্গ জলের উপর দিয়া আপন কালিমা বহিয়া নিঃশব্দে গুণ টানিয়া চলিয়ছিল রমেশ জাহাজের ছাদের সম্মুখভাগে নবেদিত শুক্লপক্ষের তরুণ চাঁদের আলোকে বেতের কেদার পশ্চিম-আকাশ হইতে সন্ধ্যার শেষ স্বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া গেল ; চন্দ্ৰলোকের ইন্দ্ৰজালে কঠিন জগৎ যেন বিগলিত হইয়া আসিল । রমেশ আপনা-আপনি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল, “হেম, হেম!” সেই নামের শব্দটিমাত্ৰ যেন সুমধুর স্পর্শরূপে তাহার সমস্ত হৃদয়কে বারংবার বেষ্টন করিয়া প্ৰদক্ষিণ করিয়া ফিরিল, সেই নামের শব্দটিমাত্ৰ যেন অপরিমেয়করুণারসান্দ্র দুইটি ছায়াময় চক্ষুরূপে তাহার মুখের উপরে বেদনা বিকীর্ণ করিয়া চাহিয়া রহিল। রমেশের সর্বশরীর পুলকিত এবং দুই চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয় আসিল । তাহার গত দুই বৎসরের জীবনের সমস্ত ইতিহাস তাহার মনের সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল । হেমনলিনীর সহিত তাহার প্রথম পরিচয়ের দিন মনে পড়িয়া গেল। সে দিনকে রমেশ তাহার জীবনের - একটি বিশেষ দিন বলিয়া চিনিতে পারে নাই | যোগেন্দ্র যখন তাহাকে তাহদের চায়ের টেবিলে লইয় গেল, সেখানে হেমনলিনীকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া লাজুক রমেশ আপনাকে নিতান্ত বিপন্ন বোধ করিয়াছিল। অল্পে অল্পে লজ্জা ভাঙিয়া গেল, হেমনলিনীর সঙ্গ অভ্যস্ত হইয়া আসিল, ক্ৰমে সেই অভ্যাসের বন্ধন রমেশকে বন্দী করিয়া তুলিল। কাব্যসাহিত্যে রমেশ প্রেমের কথা যাহা-কিছু পড়িয়ছিল সমস্তই সে হেমনলিনীর প্রতি আরোপ করিতে আরম্ভ করিল। ‘আমি ভালোবাসিতেছি। মনে করিয়া সে মনে মনে একটা অহংকার অনুভব করিল। তাহার সহপাঠীরা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হইবার জনা ভালোবাসার কবিতার অর্থ মুখস্থ করিয়া মরে, আর রমেশ সত্যসত্যই ভালোবাসে, ইহা চিন্তা করিয়া অন্য ছাত্রদিগকে সে কৃপাপাত্ৰ মনে করিত । রমেশ আজ আলোচনা করিয়া দেখিল, সেদিনও সে ভালোবাসার বহিৰ্দ্ধারেই ছিল । কিন্তু যখন অকস্মাৎ কমলা আসিয়া তাহার জীবন-সমস্যাকে জটিল করিয়া তুলিল তখনই নানা বিরুদ্ধ ঘাতপ্রতিঘাতে দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর প্রতি তাহার প্ৰেম আকার ধারণ করিয়া, জীবন গ্ৰহণ করিয়া, জাগ্রত হইয়া উঠিল । রমেশ তাহার দুই করতলের উপরে শিরা নত করিয়া ভাবিতে লাগিল, সম্মুখে সমস্ত জীবনই তো পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার ক্ষুধিত উপবাসী জীবন— দুশোচ্ছদ্য সংকটজালে বিজড়িত। এ জাল কি সে সবলে দুই হাত দিয়া ছিন্ন করিয়া ফেলিবে না ? এই বলিয়া সে দৃঢ়সংকল্পের আবেগে হঠাৎ মুখ তুলিয়া দেখিল, অদূরে আর-একটা বেতের চৌকির পিঠের উপরে হাত রাখিয়া কমলা দাড়াইয়া আছে। কমলা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তুমি ঘুমাইয়া পড়িয়ছিলে, আমি বুঝি তোমাকে জাগাইয়া দিলাম ?” অনুতপ্ত কমলাকে চলিয়া যাইতে উদ্যত দেখিয়া রমেশ তাড়াতাড়ি কহিল, “না না কমলা, আমি ঘুমাই নাই- তুমি বোসো, তোমাকে একটা গল্প বলি।” গল্পের কথা শুনিয়া কমলা পুলকিত হইয়া চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল । রমেশ স্থির করিয়াছিল, কমলাকে সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া বলা অত্যাবশ্যক হইয়াছে। কিন্তু এতবড়ো একটা আঘাত হঠাৎ সে দিতে পারিল না- তাই বলিল, “বোসো, তোমাকে একটা গল্প বলি ।” কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কবেকার কালে ? অনে-ক কাল আগে ?”