পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SVO রবীন্দ্র-রচনাবলী নামিয়া গেছে। তীরে তিমিরাচ্ছন্ন ঝোপঝাপ-গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে অদূরবতী বাজারের আলো দেশযাইতেছে। পরিপূর্ণ নদীর খরস্রোত নােঙরের লোহার শিকলে ঝংকার দিয়া চলিয়াছে এবং থাকি, থাকিয়া জাহ্নবীর স্ফীত নাড়ির কম্পবেগ স্টীমারকে স্পন্দিত করিয়া তুলিতেছে। এই অপরিস্ফুট বিপুলতা, এই অন্ধকারের নিবিড়ত, এই অপরিচিত দৃশ্যের প্রকাণ্ড অপূর্বতার মাr নিমগ্ন হইয়া রমেশ তাহার কর্তব্য-সমস্যা উদ্ভেদ করিতে চেষ্টা করিল। রমেশ বুঝিল যে, হেমনলিনী কিংবা কমলা উভয়ের মধ্যে একজনকে বিসর্জন দিতেই হইবে । উভয়কেই রক্ষা করিয়া চলিবা? কোনো মধ্যপথ নাই। তবু হেমনলিনীর আশ্রয় আছে- এখনো হেমনলিনী রমেশকে ভুলিতে পারে। সে আর-কাহাকেও বিবাহ করিতে পারে, কিন্তু কমলাকে ত্যাগ করিলে এ জীবনে তাহার আর-কোনো উপায় নাই | মানুষের স্বার্থপরতার অন্ত নাই | হেমনলিনীর যে রমেশকে ভুলিবার সম্ভাবনা আছে, তাহার রক্ষা? উপায় আছে, রমেশের সম্বন্ধে সে যে অনন্যগতি নহে, ইহাতে রমেশ কোনো সাস্তুনা পাইল না ; তাহাক আগ্রহের অধীরতা দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল । মনে হইল, এখনই হেমনলিনী তাহার সম্মুখ দিয়া যেন স্মৃলিত হইয়া চিরদিনের মতো অনায়ত্ত হইয়া চলিয়া যাইতেছে, এখনো যেন বাহু বাড়াইয়া তাহাকে ধরিতে পারা যায় । দুই করতলের উপরে সে মুখ রাখিয়া ভাবিতে লাগিল। দূরে শৃগাল ডাকিল, গ্রামে দুই-একটি অসহিষ্ণু কুকুর খেউ-খেউ করিয়া উঠিল । রমেশ তখন করতল হইতে মুখ তুলিয়া দেখিল, কমল “কমল, তুমি এখনো শুইতে যাও নাই ? রাত তো কম হয় নাই ।” কমলা কহিল, “তুমি শুইতে যাইবে না ?” রমেশ কহিল, “আমি এখনই যাইব, পুব দিকের কামরায় আমার বিছানা হইয়াছে । তুমি আর দরি করিয়ো না ।” কমলা আর কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার নির্দিষ্ট কামরায় প্রবেশ করিল। সে আর রমেশকে বলিতে পারিল না যে, কিছুক্ষণ আগেই সে ভূতের গল্প শুনিয়াছে এবং তাহার কামরা নির্জন । রমেশ কমলার অনিচ্ছুক মন্দপদবিক্ষেপে অন্তঃকরণে আঘাত পাইল ; কহিল, “ভয় করিয়ো না কমল ; তোমার কামরার পাশেই আমার কামরা— মাঝের দরজা খুলিয়া রাখিব।” কমলা স্পৰ্ধাভরে তাহার শির একটুখানি উৎক্ষিপ্ত করিয়া কহিল, “আমি ভয় করিব কিসের ?" রমেশ তাহার কামরায় প্রবেশ করিয়া বাতি নিবাইয়া দিয়া শুইয়া পড়িল ; মনে মনে কহিল, কমলাকে পরিত্যাগ করিবার কোনো পথ নাই, অতএব হেমনলিনীকে বিদায় । আজ ইহাই স্থির হইল, আর দ্বিধা করা চলে না। হেমনলিনীকে বিদায় বলিতে যে জীবন হইতে কতখানি বিদায় তাহা অন্ধকারের মধ্যে শুইয়া রমেশ অনুভব করিতে লাগিল। রমেশ আর বিছানায় চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না, উঠিয়া বাহিরে আসিল : নিশীথিনীর অন্ধকারে একবার অনুভব করিয়া লইল যে, তাহারই লজ্জা, তাহারই বেদন অনন্ত দেশ ও অনন্ত কালকে আবৃত করিয়া নাই । আকাশ পূৰ্ণ করিয়া চিরকালের জ্যোতিলোক-সকল স্তব্ধ হইয়া আছে ; রমেশ ও হেমনলিনীর ক্ষুদ্র ইতিহাসটুকু তাহাদিগকে স্পর্শও করিতেছে না ; এই আশ্বিনের নদী তাহার নির্জন বালুতটে প্রফুল্ল কাশীবনের তলদেশ দিয়া এমন কত নক্ষত্ৰলোকিত রজনীতে নিযুপ্ত গ্রামগুলির বনপ্রান্তছায়ায় প্রবাহিত হইয়া চলিবে, যখন রমেশের জীবনের সমস্ত ধিক্কার শ্মশানের ভস্মমুষ্টির মধ্যে চিরধৈর্যময়ী ধরণীতে মিশাইয়া চিরদিনের মতো নীরব হইয়া গেছে।