পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি Q心> ܘܠ পরদিন কমলা যখন ঘুম হইতে জাগিল, তখন ভোর-রাত্রি । চারি দিকে চাহিয়া দেখিল, ঘরে কেহ নাই। মনে পড়িয়া গেল, সে জাহাজে আছে। আস্তে আস্তে উঠিয়া দরজা ফাক করিয়া দেখিল, নিস্তব্ধ জলের উপর সূক্ষ্ম একটুখানি শুভ্র কুয়াশার আচ্ছাদন পড়িয়াছে, অন্ধকার পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া আসিয়াছে এবং পূর্ব দিকে তরুশ্রেণীর পশ্চাতের আকাশে স্বর্ণচ্ছটা ফুটিয়া উঠিতেছে। দেখিতে দেখিতে নদীর পাণ্ডুর নীলধারা জেলেডিঙির সাদা সাদা পালগুলিতে খচিত হইয়া উঠিল । কমলা কোনােমতেই ভাবিয়া পাইল না, তাহার মনের মধ্যে কী একটা গুঢ় বেদনা পীড়ন করিতেছে। শরৎকালের এই শিশিরবাস্পাম্বারা উষা কেন আজ তাহার আনন্দমূর্তি উদঘাটন করিতেছে না ? কেন একটা অশ্রুজিলের আবেগ বালিকার বুকের ভিতর হইতে কণ্ঠ বাহিয়া চোখের কাছে বার বার আকুল হইয়া উঠিতেছে ? তাহার শ্বশুর নাই, শাশুড়ি নাই, সঙ্গিনী নাই, স্বজন-পরিজন কেহই নাই, এ কথা কাল তো তাহার মনে ছিল না— ইতিমধ্যে কী ঘটিয়াছে যাহাতে আজ তাহার মনে হইতেছে, একলা রমেশমাত্র তাহার সম্পূর্ণ নির্ভরস্থল নহে? কেন মনে হইতেছে, এই বিশ্বভুবন অত্যন্ত বৃহৎ এবং সে বালিকা, অত্যন্ত ক্ষুদ্র ? কমলা অনেকক্ষণ দরজা ধরিয়া চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। নদীর জলপ্রবাহ তরল স্বর্ণস্রোতের মতো জুলিতে লাগিল। খালাসিরা তখন কাজে লাগিয়াছে, এঞ্জিন ধক ধিক করিতে আরম্ভ করিয়াছে, নোঙর-তোলা ও জাহাজ-ঠেলাঠেলির শব্দে অকালজাগ্ৰত শিশুর দল নদীর তীরে ছুটিয়া আসিয়াছে। এমন সময় রমেশ এই গোলমালে জাগিয়া উঠিয়া কমলার খবর লইবার জন্য তাহার দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। কমলা চকিত হইয়া, আচল যথাস্থানে থাকা সত্ত্বেও তাহা আর-একটু টানিয়া আপনাকে যেন বিশেষভাবে আচ্ছাদনের চেষ্টা করিল। রমেশ কহিল, “কমলা, তোমার মুখ-হাত ধোওয়া হইয়াছে ?” এই প্রশ্নে কেন যে কমলার রাগ হইতে পারে, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কিছুতেই বলিতে পারিত না । কিন্তু হঠাৎ রাগ হইল। সে অন্য দিকে মুখ করিয়া কেবল মাথা নাড়িল মাত্র । রমেশ কহিল, “বেলা হইলে লোকজন উঠিয়া পড়িবে, এইবোলা তৈরি হইয়া লও-না।” কমলা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া কেঁচানো শাড়ি গামছা ও একটি জামা চৌকির উপর হইতে তুলিয়া লইয়া দ্রুতপদে রমেশের পাশ দিয়া সুমানের ঘরে চলিয়া গেল । রমেশ যে প্ৰাতঃকালে উঠিয়া কমলাকে এই যত্নটুকু করিতে আসিল ইহা কমলার কাছে কেবল যে অত্যন্ত অনাবশ্যক বোধ হইল তাহা নহে, ইহা যেন তাহাকে অপমান করিল । রমেশের আত্মীয়তার সীমা যে কেবল খানিকটা দূর পর্যন্ত, এক জায়গায় আসিয়া তাহা যে বাধিয়া যায়, ইহা সহসা কমলা অনুভব করিতে পারিয়াছে। শ্বশুরবাড়ির কোনো গুরুজন তাহাকে লজ্জা করিতে শেখায় নাই, মাথায় কোন অবস্থায় ঘোমটার পরিমাণ কতখানি হওয়া উচিত তাহাও তাহার অভ্যস্ত হয় নাই- কিন্তু রমেশ সম্মুখে আসিতেই আজ কোন অকারণে তাহার বুকের ভিতরটা লজ্জায় কুষ্ঠিত হইতে লাগিল । স্নান সারিয়া কমলা যখন তাহার কামরায় আসিয়া বসিল তখন তাহার দিনের কর্ম তাহার সম্মুখবর্তী হইল। কঁধের উপর হইতে আঁচলে-বাধা চাবির গোছা লইয়া কাপড়ের পোর্টম্যান্টে খুলিতেই তাহার মধ্যে ছােটাে ক্যাশবাক্সটি নজরে পড়িল। এই কাশবাক্সটি পাইয়া কাল কমলা একটি নূতন গৌরব লাভ করিয়াছিল। তাহার হাতে একটি স্বাধীন শক্তি আসিয়াছিল। তাই সে বহু যত্ন করিয়া বাক্সটি তাহার কাপড়ের তেরঙ্গের মধ্যে চাবি-বন্ধ করিয়া রাখিয়ছিল। আজ কমলা সে বাক্স হাতে তুলিয়া লইয়া উল্লাসবোধ করিল না । আজ এ ব্যাক্সকে ঠিক নিজের বাক্স মনে হইল না,ইহা রমেশেরই বাক্স । এ বাক্সের মধ্যে কমলার পূর্ণস্বাধীনতা নাই। সুতরাং এ টাকার বাক্স কমলার পক্ষে একটা ভারমাত্র। রমেশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিল, “খোলা বাক্সের মধ্যে কী হেঁয়ালির সন্ধান পাইয়াছ ? চুপচাপ বসিয়া যে ?”