পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

აჯხ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী গভীরমুখে তাহার শাক, তাহার তরকারি, তাহার বেগুন কুটিয়া রান্না চড়াইয়া দিল। হায়, এই গৃহচ্যুত ছেলেটাকে প্রশ্রয় না দিয়াই বা কমলা থাকে কী করিয়া ? শাক-চুরির গুরুত্ব যে কতখানি তাহা কমলা ঠিক বোঝে না ; কিন্তু নিরাশ্রয় ছেলের নির্ভরলালসা যে কত একান্ত তাহা তো সে বোঝে। ঐ-যে কমলাকে একটুখানি খুশি করিবার জন্য এই লক্ষ্মীছাড়া বালক কাল হইতে এই কয়েকটা শাক-সংগ্রহের অবসর খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। আর-একটু হইলেই স্টীমার হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়াছিল, ইহার করুণা কি কমলাকে স্পর্শ না করিয়া থাকিতে পারে ? কমলা কহিল, “উমেশ, তোর জন্যে কালকের সেই দই কিছু বাকি আছে, তোকে আজ আবার দই খাওয়াইব, কিন্তু খবরদার, এমন কাজ আর কখনো করিস নে ৷” উমেশ অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া কহিল, “মা, তবে সে দই তুমি কাল খাও নাই ?” কমলা কহিল, “তোর মতো দইয়ের উপর আমার অত লোভ নাই | কিন্তু উমেশ, সব তো হইল, মাছের জোগাড় কি হইবে ? মাছ না পাইলে বাবুকে খাইতে দিব কী ?” উমেশ । মাছের জোগাড় করিতে পারি মা, কিন্তু সেটা তো মিনি পয়সায় হইবার জো নাই । কমলা পুনরায় শাসনকার্যে প্রবৃত্ত হইল। তাহার সুন্দর দুটি ভুকুঞ্চিত করিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “উমেশ তাের মতাে নিবোধ আমি তাে দেখি নাই। আমি কি তােকে মিনি পয়সায় জিনিস সংগ্ৰহ গতকল্য উমেশের মনে কী করিয়া একটা ধারণা হইয়া গেছে যে, কমলা রমেশের কাছ হইতে টাকা আদায় করাটা সহজ মনে করে না। তা ছাড়া, সবসুদ্ধ জড়াইয়া রমেশকে তাহার ভালো লাগে নাই । এইজন্য রমেশের অপেক্ষা না রাখিয়া, কেবল সে এবং কমলা, এই দুই নিরুপায়ে মিলিয়া কী উপায়ে সংসার চালাইতে পারে তাহার গুটিকতক সহজ কৌশল সে মনে মনে উদভাবন করিতেছিল। শাক-বেগুন-কাচকলা সম্বন্ধে সে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিল, কিন্তু মাছটার বিষয়ে এখনো সে যুক্তি স্থির করিতে পারে নাই। পৃথিবীতে নিঃস্বাৰ্থ ভক্তির জোরে সামান্য দই-মাছ পৰ্যন্ত জোটানো যায় না, পয়সা চাই ; সুতরাং কমলার এই অকিঞ্চন ভক্ত-বালকাঁটার পক্ষে পৃথিবী সহজ জায়গা নহে। উমেশ কিছু কাতর হইয়া কহিল, “মা, যদি বাবুকে বলিয়া কোনােমতে গণ্ডার্পাচেক পয়সা জোগাড় করিতে পাের, তবে একটা বড়ো রুই আনিতে পারি।” কমলা উদবিগ্ন হইয়া কহিল, “না না, তোকে আর স্টীমার হইতে নামিতে দিব না, এবার তুই ডাঙায় পড়িয়া থাকিলে তোকে কেহ আর তুলিয়া লইবে না।” উমেশ কহিল, “ডাঙায় নামিব কেন ? আজ ভোরে খালাসিদের জালে খুব বড়ো মাছ পড়িয়ছে ; এক-আধটা বেচিতেও পারে।” শুনিয়া দ্রুতবেগে কমলা একটা টাকা আনিয়া উমেশের হাতে দিল ; কহিল, “যাহা লাগে দিয়া বাকি ফিরাইয়া আনিস ।” উমেশ মাছ আনিল, কিন্তু কিছু ফিরাইয়া আনিল না ; বলিল, “এক টাকার কমে কিছুতেই দিল N. " কথাটা যে খাটি সত্য নহে তাহা কমলা বুঝিল ; একটু হাসিয়া কহিল, “এবার স্টীমার থামিলে টাকা ভাঙাইয়া রাখিতে হইবে।” উমেশ গভীরমুখে কহিল, “সেটা খুব দরকার। আস্ত টাকা একবার বাহির হইলে ফেরানাে শক্ত ৷” আহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়া রমেশ কহিল, “বড়ো চমৎকার হইয়াছে। কিন্তু এ-সমস্ত জোটাইলে কোথা হইতে ? এ যে রুইমাছের মুড়ো।” বলিয়া মুড়োটা সযত্নে তুলিয়া ধরিয়া কহিল, “এ তো স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্ৰম নয়- এ যে সত্যই মুড়ো- যাহাকে বলে রোহিত মৎস্য তাঁহারই উত্তমাঙ্গ ।” এইরূপে সেদিনকার মধ্যাহ্নভোজন বেশ সমারোহের সহিত সম্পন্ন হইল। রমেশ ডেকে আরাম-কেদারায় গিয়া পরিপাক-ক্রিয়ায় মনোযোগ দিল । কমলা তখন উমেশকে খাওয়াইতে বসিল । মাছের চচ্চড়িটা উমেশের এত ভালো লাগিল যে, ভোজনের উৎসাহটা কৌতুকাবহ না হইয়া ক্রমে