পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি RVS) d খানিকটা বিক্ষিপ্ত করিতে পারে তবে রমেশ আপনার হৃদয়ের ক্ষতবেদনায় অখণ্ড মনোযোগ দিয়া (5 | দীৰ্ঘমধ্যাহ্নটা সে চক্রবর্তীকে একাকী দখল করিয়া বসে । চক্রবর্তী তাহাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “না না মা, এটা ভালো হইল না। এটা কিছুতেই চলিবে না।” কমলা, কী ভালো হইল না কিছু বুঝিতে না পারিয়া আশ্চর্য ও কুষ্ঠিত হইয়া উঠিল। বৃদ্ধ কহিলেন, “ঐ-যে, ঐ জুতোটা। রমেশবাবু, এটা আপনা কর্তৃকই হইয়াছে। যা বলেন, এটা আপনারা অধৰ্ম করিতেছেন- দেশের মাটিকে এই সকল চরণস্পর্শ হইতে বঞ্চিত করবেন না, তাহা হইলে দেশ মাটি হইবে। রামচন্দ্ৰ যদি সীতাকে ডসনের বুট পরাইতেন তবে লক্ষ্মণ কি চােদ্দ বৎসর বনে ফিরিয়া বেড়াইতে পারিতেন মনে করেন ? কখনোই না। আমার কথা শুনিয়া রমেশবাবু হাসিতেছেন, মনে মনে ঠিক পছন্দ করিতেছেন না ; না করিবারই কথা। আপনারা জাহাজের বাঁশি শুনিলেই আর থাকিতে পারেন না, একেবারেই চড়িয়া বসেন, কিন্তু কোথায় যে যাইতেছেন তাহা একবারও ভাবেন | T রমেশ কহিল, “খুড়ো, আপনিই নাহয় আমাদের গম্যস্থানটা ঠিক করিয়া দিন-না। জাহাজের বঁাশিটার চেয়ে আপনার পরামর্শ পাকা হইবে।” চক্রবর্তী কহিলেন, “এই দেখুন, আপনার বিবেচনাশক্তি এরই মধ্যে উন্নতি লাভ করিয়াছে— অথচ অল্পক্ষণের পরিচয় । তবে আসুন, গাজিপুরে আসুন। যাবে মা, গাজিপুরে ? সেখানে গোলাপের খেত আছে, আর সেখানে তোমার এ বৃদ্ধ ভক্তটাও থাকে।” রমেশও কমলার মুখের দিকে চাহিল। কমলা তৎক্ষণাৎ ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল । । ইহার পরে উমেশ এবং চক্রবর্তীতে মিলিয়া লজ্জিত কমলার কামরায় সভাস্থাপন করিল। রমেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাহিরেই রহিয়া গেল। মধ্যাহ্নে জাহাজ ধক ধক করিয়া চলিয়াছে। শারদরৌদ্ররঞ্জিত দুই তীরের শান্তিময় বৈচিত্ৰ্য স্বপ্নের মতো চোখের উপর দিয়া পরিবর্তিত হইয়া চলিয়াছে। কোথাও বা ধানের খেত, কোথাও বা নীেকা-লাগানো ঘাট, কোথাও বা বালুর তীর, কোথাও বা গ্রামের গোয়াল, কোথাও বা গঞ্জের টিনের ছাদ, কোথাও বা প্রাচীন ছায়াবটের তলে খেয়াতরীর-অপেক্ষী দুটি-চারটি পারের যাত্রী। এই শরৎমধ্যাহ্নের সুমধুর স্তব্ধতার মধ্যে অদূরে কামরার ভিতর হইতে যখন ক্ষণে ক্ষণে কমলার স্নিগ্ধ কৌতুকহাস্য রমেশের কানে আসিয়া প্রবেশ করিল। তখন তাহার বুকে বাজিতে লাগিল। সমস্তই কী সুন্দর, অথচ কী সুদূর । রমেশের আর্ত জীবনের সহিত কী নিদারুণ আঘাতে বিচ্ছিন্ন । R কমলার এখনো অল্প বয়স- কোনো সংশয় আশঙ্কা বা বেদনা স্থায়ী হইয়া তাহার মনের মধ্যে টিকিয়া থাকিতে পারে না। রমেশের ব্যবহার সম্বন্ধে এ কয়দিন সে আর-কোনাে চিন্তা করিবার অবকাশ পায় নাই। স্রোত যেখানে বাধা পায় সেইখানে যত আবর্জনা আসিয়া জমে- কমলার চিত্তস্রোতের সহজ প্রবাহ। রমেশের আচরণে হঠাৎ একটা জায়গায় বাধা পাইয়াছিল, সেইখানে আবর্ত রচিত হইয়া নানা কথা বারবার একই জায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বৃদ্ধ চক্রবতীকে লইয়া হাসিয়া, বকিয়া, রাধিয়া, খাওয়াইয়া কমলার হৃদয়স্রোত আবার সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল ; আবর্ত কাটিয়া গৈল ; যাহা-কিছু জমিতেছিল এবং ঘুরিতেছিল তাহা সমস্ত ভাসিয়া গেল। সে আপনার কথা আর কিছুই ভাবিল না। আশ্বিনের সুন্দর দিনগুলি নদীপথের বিচিত্র দৃশ্যগুলিকে রমণীয় করিয়া তাঁহারই মাঝখানে কমলার