পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NRA NR রবীন্দ্র-রচনাবলী কোথাকার, যা খুড়োমশায়ের সঙ্গে শুইতে যা ।” কমলার মুখে লক্ষ্মীছাড়া-সম্বোধনে উমেশ বিশেষ পরিতৃপ্ত হইয়া চক্রবর্তী-খুড়ার সঙ্গে শুইতে গেল । রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “যতক্ষণ না ঘুম আসে। আমি বসিয়া গল্প করিব কি ?” কমলা কহিল, “না, আমার ভারি ঘুম পাইয়াছে।” ra রমেশ কমলার মনের ভাব যে না বুঝিল তাহা নয়, কিন্তু সে আর দ্বিরুক্তি করিল না ; কমলার অভিমানক্রুগ্ন মুখের দিকে তাকাইয়া সে ধীরে ধীরে আপন কক্ষে চলিয়া গেল। বিছানার মধ্যে স্থির হইয়া ঘুমের অপেক্ষায় পড়িয়া থাকিতে পারে, এমন শান্তি কমলার মনে ছিল না। তবু সে জোর করিয়া শুইল।। ঝড়ের বেগের সঙ্গে জলের কল্লোল ক্ৰমে বাড়িয়া উঠিল। খালাসিদের গোলমাল শোনা যাইতে লাগিল। মাঝে মাঝে এঞ্জিন-ঘরে সারেঙের আদেশসূচক ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। প্রবল বায়ুবেগের বিরুদ্ধে জাহাজকে স্থির রাখিবার জন্য নোঙর-বাধা অবস্থাতেও এঞ্জিন ধীরে ধীরে চলিতে থাকিল । কমলা বিছানা ছাড়িয়া কামরার বাহিরে আসিয়া দাড়াইল। ক্ষণকালের জন্য বৃষ্টির বিশ্রাম হইয়াছে, কিন্তু ঝড়ের বাতাস শরবিদ্ধ জন্তুর মতো চীৎকার করিয়া দিগবিদিকে ছুটিয়া বেড়াইতেছে। মেঘসত্ত্বেও শুক্লাচতুৰ্দশীর আকাশ ক্ষীণ আলোকে অশান্ত সংহারমূর্তি অপরিস্ফুটভারে প্রকাশ করিতেছে। তীর স্পষ্ট লক্ষ্য হইতেছে না ; নদী ঝাপসা দেখা যাইতেছে ; কিন্তু উর্ধের্ব নিম্নে, দূরে নিকটে, দৃশ্যে অদৃশ্যে একটা মূঢ় উন্মত্ততা, একটা অন্ধ আন্দােলন যেন অদ্ভুত মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া যমরাজের উদ্যতশৃঙ্গ কালো মহিষটার মতো মাথা ঝাকা দিয়া দিয়া উঠিতেছে। এই পাগল রাত্রি, এই আকুল আকাশের দিকে চাহিয়া, কমলার বুকের ভিতরটা যে দুলিতে লাগিল তাহা ভয়ে কি আনন্দে নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না । এই প্রলয়ের মধ্যে যে একটা বাধাহীন শক্তি, একটা বন্ধনহীন স্বাধীনতা আছে, তাহা যেন কমলার হৃদয়ের মধ্যে একটা সুপ্ত সঙ্গিনীকে জাগাইয়া তুলিল। এই বিশ্বব্যাপী, বিদ্রোহের বেগ কমলার চিত্তকে বিচলিত করিল। কিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তাহার উত্তর কি এই ঝড়ের গর্জনের মধ্যে পাওয়া যায় ? না, তাহা কমলার হৃদয়াবেগেরই মতো অব্যক্ত। একটা কোন অনির্দিষ্ট অমূর্ত মিথ্যার, স্বপ্নের, অন্ধকারের জাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আসিবার জন্য আকাশপাতালে এই মাতামতি, এই রোষগৰ্জিত ক্ৰন্দন । পথহীন প্ৰান্তহীন প্রাস্তরের প্রান্ত হইতে বাতাস কেবল 'না না বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে নিশীথরাত্রে ছুটিয়া আসিতেছেএকটা কেবল প্রচণ্ড অস্বীকার। কিসের অস্বীকার ? তাহা নিশ্চয় বলা যায় না- কিন্তু না— কিছুতেই না, না, না, না | WO পরদিন প্রাতে ঝড়ের বেগ কিছু কমিয়াছে, কিন্তু একেবারে থামে নাই। নোঙর তুলিবে কি না। এখনো তাহা সারেং ঠিক করিতে পারে নাই, উদবিগ্নমুখে আকাশের দিকে তাকাইতেছে। তখনো বিছানায় পড়িয়া আছে, চক্রবতীকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল । এই ঘরে রমেশের করিলেন, “কাল রাত্ৰে বুঝি এই ঘরেই শোওয়া হইয়াছিল ?” রমেশ এই প্রশ্নের উত্তর এড়াইয়া কহিল, “এ কী দুৰ্যোগ আরম্ভ হইয়াছে ! কাল রাত্রে খুড়োর ঘুম কেমন হইল ?” চক্রবর্তী কহিলেন, “আমাকে নির্বোধের মতো দেখিতে, আমার কথাবার্তাও সেই প্রকারের, তবু এই বয়সে আমাকে অনেক দুরূহ বিষয়ের চিন্তা করিতে হইয়াছে এবং তাহার অনেকগুলার মীমাংসাও পাইয়াছি- কিন্তু আপনাকে সব চেয়ে দুরূহ বলিয়া ঠেকিতেছে।”