পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি -- RAO মুহুর্তের জন্য রমেশের মুখ ঈষৎ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া একটুখানি হাসিয়া কহিল, “দুরূহ হওয়াটাই যে সব সময়ে অপরাধের তা নয় খুড়ো। তেলেগু ভাষার শিশুপাঠও দুরূহ, কিন্তু ত্রৈলঙ্গের বালকের কাছে তাহা জলের মতাে সহজ। যাহাকে না বুঝিবেন তাহাকে তাড়াতাড়ি দোষ দিবেন না এবং যে অক্ষর না বোঝেন কেবলমাত্র তাহার উপরে অনিমেষ চক্ষু রাখিলেই যে তাহা কোনোকালে বুঝিতে পরিবেন এমন আশা করবেন না।” বৃদ্ধ কহিলেন, “আমাকে মাপ করিবেন রমেশবাবু। আমার সঙ্গে যাহার বোঝাপড়ার কোনো সম্পর্ক নাই তাহাকে বুঝিতে চেষ্টা করাই খৃষ্টতা। কিন্তু পৃথিবীতে দৈবাৎ এমন এক-একটি মানুষ মেলে, দৃষ্টিপাতমাত্রই যাহার সঙ্গে সম্বন্ধ স্থির হইয়া যায়। তার সাক্ষী, আপনি ঐ দেড়ে সারেংটাকে জিজ্ঞাসা করুন— বউমার সঙ্গে ওর আত্মীয়সম্বন্ধ ওকে এখনই স্বীকার করিতে হইবে ; ওর ঘাড় করিবে ; না করে তো ওকে আমি মুসলমান বলিব না। এমন অবস্থায় হঠাৎ মাঝখানে তেলেগু ভাষা আসিয়া পড়িলে ভারি মুশকিলে পড়িতে হয়। শুধু শুধু রাগ করিলে চলিবে না। রমেশবাবু, কথাটা ভাবিয়া দেখিবেন ।” রমেশ কহিল, “ভাবিয়া দেখিতেছি বলিয়াই তো রাগ করিতে পারিতেছি না ; কিন্তু আমি রাগ করি আর না করি, আপনি দুঃখ পান। আর না পান, তেলেগু ভাষা তেলেগুই থাকিয়া যাইবে- প্রকৃতির এইরূপ নিষ্ঠুর নিয়ম।” এই বলিয়া রমেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । ইতিমধ্যে রমেশ চিন্তা করিতে লাগিল, গাজিপুরে যাওয়া উচিত কি না। প্রথমে সে ভাবিয়ছিল, অপরিচিত স্থানে বাসস্থাপন করার পক্ষে বৃদ্ধের সহিত পরিচয় তাহার কাজে লাগিবে। কিন্তু এখন মনে হইল, পরিচয়ের অসুবিধাও আছে। কমলার সহিত তাহার সম্বন্ধ আলোচনা ও অনুসন্ধানের বিষয় হইয়া উঠিলে একদিন তাহা কমলার পক্ষে নিদারুণ হইয়া দাড়াইবে । তার চেয়ে যেখানে সকলেই অপরিচিত, যেখানে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার কেহ নাই, সেইখানে আশ্রয় লওয়াই ভালো । গাজিপুরে পীে ছিবার আগের দিনে রমেশ চক্রবর্তীকে কহিল, “খুড়ো, গাজিপুর আমার প্র্যাকটিসের পক্ষে অনুকূল বলিয়া বুঝিতেছি না, আপাতত কাশীতে যাওয়াই আমি স্থির করিয়াছি।” রমেশের কথার মধ্যে নিঃসংশয়ের সুর শুনিয়া বৃদ্ধ হাসিয়া কহিলেন, “বারবার ভিন্ন ভিন্ন রকম স্থির করাকে স্থির করা বলে না- সে তো অস্থির করা । যা হউক, এই কাশী যাওয়াটা এখনকার মতো আপনার শেষ স্থির ?” রমেশ সংক্ষেপে কহিল, “ই ।” বৃদ্ধ কোনাে উত্তর না করিয়া চলিয়া গেলেন এবং জিনিসপত্র বঁাধিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কমলা আসিয়া কহিল, “খুড়োমশায়, আজ কি আমার সঙ্গে আড়ি ?” বৃদ্ধ কহিলেন, “ঝগড়া তো দুই বেলাই হয়, কিন্তু একদিনও তো জিতিতে পারিলাম না।” কমলা। আজ যে সকাল হইতে তুমি পালাইয়া বেড়াইতেছ ? চক্রবর্তী । তোমরা যে মা, আমার চেয়ে বড়ো রকমের পলায়নের চেষ্টায় আছ, আর আমাকে পলাতক বলিয়া অপবাদ দিতেছ ? কমলা কথাটা না বুঝিয়া চাহিয়া রহিল। বৃদ্ধ কহিলেন, “রমেশবাবু। তবে কি এখনো বলেন নাই ? তোমাদের যে কাশী যাওয়া স্থির হইয়াছে।” শুনিয়া কমলা হাঁ-না কিছুই বলিল না। কিছুক্ষণ পরে কহিল, “খুড়োমশায়, তুমি পরিবে না ; দাও, তোমার বাক্স আমি সাজাইয়া দিই ।” কাশী যাওয়া সম্বন্ধে কমলার এই ঔদাসীন্যে চক্রবর্তী হৃদয়ের মধ্যে একটা গভীর আঘাত পাইলেন। মনে মনে ভাবিলেন, “ভালোই হইতেছে, আমার মতো বয়সে আবার নূতন জাল জড়ানো Gn ' ইতিমধ্যে কাশী যাওয়ার কথা কমলাকে জানাইবার জন্য রমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল,